জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

নবীবিদ্বেষীদের শক্তির খুঁটি কোথায়?

মাহদী গালিবঃ মোটা দাগে বলতে পারি, পশ্চিমা বা ইউরোপীয়দের এতো সৈন্য এতো বন্দুক বিমান প্রযুক্তি ইত্যাদি আছে। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, তাদের অর্থনীতি অনেক শক্তিধর। হ্যাঁ, পরিসংখ্যান এগুলাই বলে। এসব সত্য। কিন্তু পরিসংখ্যানের বাহিরেও কিছু আছে। যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই সামনে আনা হয় না। কাউকে সে স্টাইলে ভাববার সুযোগও দেয় হয় না। আর এই ভাবতে না দেয়াটাই হচ্ছে ‘মানসিক-পঙ্গুত্ব’।
মানসিক-পঙ্গুত্বের তিনটি অংশ। চিন্তার জড়তা, বুদ্ধির অসাড়তা, চেতনার পরিচয়হীনতা। এসব অনেক জটিল ও লম্বা আলাপ, আজ থাক। সোজাসাপটা শেষ করি।
পশ্চিমারা আমাদের দুইভাবে আইডেন্টিটি-ক্রাইসিস বা আত্মপরিচয়হীনতায় ফেলেছে। প্রথমত সভ্যতার মাপকাঠিতে, মানে অর্থনীতি-সমরশক্তি-প্রযুক্তি-কূটনীতি ইত্যাদির মেকি জৌলুষ দেখিয়ে। দ্বিতীয়ত, আমাদের দর্শন-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ইতিহাসকে ছোটলোকের বিলাস বানিয়ে। দ্বিতীয় অংশটা আগে আলাপ করি।
দেখুন, ডিসি বা মার্ভেলের দুঘন্টার ছবি আমরা আয়েশ করে দেখি। সুপারম্যান, থর, আয়রনম্যান- এসব ছবির প্রোডাকশন হাউজ হচ্ছে ডিসি ও মার্ভেল। যাহোক, এসব ছবি দেখা আমাদের কাছে রুচি, ক্লাস, স্ট্যান্ডার্ড। খাস বাংলায় কৌলিন্য, উঁচা জাতের পরিচয়।
খেয়াল করুন, পশ্চিমারা যেটা দেখায়, আমরা দেখি, দেখে বড়াইও করি। মানে পশ্চিমাদের সাথে সখ্যতাই আমাদের জাতের স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করে। কিন্তু সেই আমাদের যখন বলা হয়, অমুক আউলিয়া মাছের পীঠে চড়ে এদেশে এসেছেন, তমুক পীর সমুক করেছে, তখন আমরাই নাক সিঁটকাই। এসব মানলে আমাদের জাত থাকে না। অথচ ডিসি-মার্ভেলের ছবিতে একই জিনিস দেখায়। পশ্চিমারা বানালে ক্লাস, নিজের মাটিতে মিশে থাকা কল্প-গল্প হচ্ছে খ্যাত! বুঝতে পারছেন, আমাদের চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধি কতোটা পশ্চিমা নির্ভর?
বলতে পারেন, আরে ছবি তো বিনোদন, এসব কী ধর্ম নাকি? জি ভাই, শত্রুর পণ্যকে বিনোদনের তকমা দিয়ে মাথার মুকুট বানান; আর নিজ মাটি-মানুষ-মননের ঐতিহ্য হচ্ছে অচ্ছুৎ, ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না, ছুলে যাবে জাত; এসব শিকির-বেদাত-ছোটলোকি!
পীর-আউলিয়ার সব ঘটনাই সত্য কী-না, সে তর্কে যাচ্ছি না। শুধু বুঝাতে চাচ্ছি, নিজ জিনিসের প্রতি আমরা কতোটা উদাসী, কতোটা জুলুম করি।
এই মনোভাব তৈরি করা হয়েছে, এমনি এমনি আসেনি। শত শত বছরের প্ল্যানিং এর ফসল এসব। বৃটিশ শোষকদের অদৃশ্য বর্ণবাদের বীজ আজ বিশাল বটবৃক্ষ। শেকড়বাকড় অনেক গভীরে ছড়িয়েছে। এতোটাই যে, আমরা আমাদের স্ট্যান্ডার্ড খুঁজি তাদের দেয়া সংজ্ঞায়। ইংরেজি সাহিত্য পড়লে উপদেবতা হই, বাংলা পড়লে ভাবি- মাস্টারি করেই খেতে হবে, মাদ্রাসা পাস মানে আদিযুগের গুহামানব।
আমাদের মানসিক-পঙ্গুত্ব এতটাই বেশি যে, নিজেদের মুসলিম দাবী করি। অথচ মুসলিম পরিচয়ের মৌলিক মানদণ্ড যিনি, সেই রাসুল-অতুল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এঁর সমুচ্চ সম্মানকে সন্দেহ করে বসি। নবীজি যে খোদার কুদরতে এখনো স্বশরীরে জীবিত, তিনি চাইলেই দেখা দিতে পারেন, তিনি জানেন আমরা কী করছি না করছি- এসব মানতে চাই না। শিরিক-বেদাতের ফতোয়া দেই। ইসলামের আধ্যাত্মের অংশটাকেই ভাবি গরিবের বিলাস, ছোটলোকি। ইসলাম থেকে যদি আধ্যাত্মকে বাদ দেই, তবে বস্তুবাদী অন্যান্য মতবাদের সাথে, নাস্তিকদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা কই?
সাথে সাথে ওহাবি-সালাফিরা যখন সাহাবাগণের পবিত্র মাজারগুলো, অবকাঠামোগত ঐতিহ্য ধ্বংস করে, তখন এটাকে ভাবি সংস্কার। হাজার বছরের মাযহাব, তরিকত ছেড়ে, পা-চাটা সৌদদের ওহাবি-সালাফিবাদকে মডার্ন আখ্যা দেই, গ্রহণ করি।
একটু নিরপেক্ষ ভাবে ভাবুন। আমাদের পরিচিয়ের স্তম্ভগুলো ধুলোয় মিটে গেল। আমাদের দর্শন-চেতনাকে শিরিক-বেদাতি বলে ব্রান্ডিং করা হলো, এসব কী আমাদের মনে কোন দাগ ফেলেছে? আমরা কী অদৌ আমাদের পরিচিয় সম্পর্কে সচেতন? উদাসীন নই? জালিম নই?
এবার প্রথম অংশে আসুন।
পশ্চিমাদের জৌলুষ কিন্তু রক্তচোষা অধ্যায়। মানবেতিহাসে মোঙ্গলদের মতোই সমানতালে বেশি মানুষ মেরেছে পশ্চিমারা। সেটা ক্রসেড থেকে শুরু করে শিল্পবিপ্লব পরবর্তী উপনিবেশবাদ হয়ে, আজকে সন্ত্রাস দমন নামক যুদ্ধবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। শুধু তাই না, তারা উপনিবেশবাদ বাহ্যিক ভাবে ছাড়লেও, জন্ম দিয়েছে নব্য-উপনিবেশবাদের। কোথাও একচেটিয়া বাণিজ্যনীতি বহাল রেখে, কোথাও শ্রমদাস প্রজন্ম তৈরি করে, কোথাও কোথাও এখনো নামমাত্র স্বাধীন দেশগুলো থেকে সরাসরি কর/খাজনা আদায় করে। যেমন ফ্রান্স এখনো কাড়ি কাড়ি অর্থ চুষে নেয় আফ্রিকায়। বাস্তবতা হচ্ছে, এই নিছক স্বাধীনদশগুলো না থাকলে, পশ্চিমারা আজ বাংলাদেশের থেকেও গরিবদেশ হতো।
গালফ অঞ্চলের সন্ত্রাস সৌদদের কথাই ভাবুন, এই বেদুঈন ডাকাতেরা ভালোমতই জানে, পশ্চিমারা তাদের মসনদ দিয়েছে, তাদের পদলেহন না করলে গদি টিকবে না। তাই মুসলিম দাবীদার হওয়া সত্ত্বেও তারা ইয়ামেনে হামলা করবে, কাতার অবরুদ্ধ করবে, তুর্কি পণ্য ছুঁড়ে ফেলবে। অপর দিকে পশ্চিম থেকে বিলিয়ন ডলার অস্ত্র কিনে, তেল দেয়, উপহার পাঠায়। যতই যাই হোক, পশ্চিমা-দেবতাদের খুশি রাখতে হবে।
ইতিহাসে সবচে অমানবিক অধ্যায় হচ্ছে পশ্চিমাদের। অথচ এরাই মিউজিয়ামের বাহার দেখাবে, ছবি, মূর্তি, কবিতা, সিনেমা সবার থেকে মানবিক ও আপার লেভেলের বলে প্রতিষ্ঠিত করে ছেড়েছে। তাদের শিল্পই কলার মানদণ্ড বলে একচেটিয়া দাবী করছে। আর আমরা তাদেরটা দেখেই নমঃ নমঃ করি।
এতোক্ষণ ধর এটাই বুঝাতে চাচ্ছি, নবীবিদ্বেষীদের মূল শক্তি হচ্ছি আমরা। আমরাদের মূর্খতা, আত্মপরিচয়হীনতাই হচ্ছে তাদের মৌলিক হাতিয়ার। আপনার বাপ সম্পর্কে আপনি নিজেই সন্দিহান হলে, অন্যজন আপনাকে জারজ বলতে ভয় পাবে না, এটাই বাস্তবতা।
ফ্রান্সের সমস্য হচ্ছে সভ্যতাগত। এরা শুরু থেকেই মুসলিম মূল্যবোধ ও মানবিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত। ফ্রান্স আজকে যা করেছে, তা আগেও করেছে, সামনেও করবে। যতোদিন না আমরা নিজপরিচয় বুক ফুলিয়ে বলতে পারব, তাদের ঠুনকো ও অসত্য-অসভ্য সভ্যতার অনুকরণ না ছাড়ব, তাদের চিন্তাকে আপার ক্লাস ভাবা ছাড়ব না, ততদিন তারা এসব করেই যাবে।
জানি একদিনে সম্ভব না। ওসমানিরা চলে যাবার পর, জায়োনিস্টদের প্রকাশ্যে উত্থানের পর, ভোগবাদের মেকি গ্লোবালাইজেশনের পথ পরিষ্কার হবার সাথে সাথে, মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের কফিনে শেষ পেরেক ঢুকেছে অনেক আগেই।
কয়েক শতাব্দীর প্ল্যানিং লাগবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে হবে। বুদ্ধির মুক্তি আনতে হবে, চিন্তার মুক্তি লাগবে, চেতনার পরিচয় বুক ফুলিয়ে লালন করতে হবে। স্বাধীন ও স্বনির্ভর প্রজন্ম গড়েতে হবেই হবে।
এসব যদি আজ, এখন থেকে না শুরু করি, তবে আরো কয়েকটা শতাব্দী হয়ত এমনি যাবে। তারা কার্টুন বানাতেই থাকবে, আরো বহু কিছু করবে। কষ্ট দিয়েই যাবে মানবতার জন্য চির ব্যথিত সত্তাকে, আমার প্রাণের রাসুলকে, প্রেমের রাসুলকে।
হে মুসলিম, হৃদয় কানে শুনে দেখ, সেই সবুজ গম্বুজের নিচে, তোমার রাসুল এখনো কাঁদেন আর ডাকেন- উম্মাতি! উম্মাতি!