হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানাধীন দিগম্বরপুর বাজারের তৃতীয় তলার ভাড়াটিয়া বাসায় মা ও মেয়ের হত্যা কান্ডের রহস্য উদঘাটিত হয়েছে।
গত ১৭/০৩/২০২১ খ্রিঃ তারিখ সকাল অনুমান ০৮.০০ ঘটিকার সময় সংবাদ পাওয়া যায় যে, বাহুবল মডেল থানাধীন ০২নং পুটিজুরী ইউনিয়নের দিগম্বরপুর বাজারের জনৈক আব্দুল মুমিন তালুকদারের তিনতলার ভাড়াটিয়া বাসায় ০২টি মৃতদেহ পড়ে আছে। উক্ত সংবাদের প্রেক্ষিতে বাহুবল মডেল থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
তদন্ত সহায়তার জন্য পিবিআই, হবিগঞ্জ এবং ক্রাইম সিন ইউনিট, সিআইডি, সিলেটকে সংবাদ প্রদান করলে তারা ঘটনাস্থলে এসে আলামত সংগ্রহে সহায়তা করেন। ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা মৃতদেহ দুটির পরিচয় অঞ্জলি মালাকার (৩০), পিতা-কার্তিক মালাকার, সাং-কোদালী, থানা-বড়লেখা, জেলা-মৌলভীবাজার এবং তার মেয়ে পূজা রানী দাস (০৮) বলে জানা যায়।
মৃতদেহ দুটির সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতকালে অঞ্জলি মালাকারের গলাকাটা, ঠোট, গাল ও পেটে রক্তাক্ত কাটা জখম এবং তার মেয়ের পূজা রানীর গলাকাটা পাওয়া যায়। মৃত অঞ্জলি মালাকারের স্বামী সনজিত (৪৫) জানায় ঘটনার সময় সে বাড়িতে ছিল না। কাঁচা মরিছ ক্রয়ের জন্য সুনামগঞ্জ জেলায় গিয়েছিল এবং সকালে এসে তার ঘরে প্রবেশ করে তার স্ত্রী ও মেয়ের রক্তাক্ত লাশ দেখতে পায়। সে আরও জানায় তার ঘরে থাকা ১ লক্ষ নব্বই হাজার টাকা, তার স্ত্রীর হাতে থাকা দেড় ভরি ওজনের স্বর্ণের বালা এবং তার স্ত্রীর ব্যবহৃত একটি স্যামপনী এন্ড্রয়েড ফোন ঘরে পাওয়া যায়নি।
ঘটনার পরপরেই ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য সহকারী পুলিশ সুপার, বাহুবল সার্কেল, অফিসার ইনচার্জ, বাহুবল মডেল থানা ও টিম বাহুবল থানাকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
উল্লিখিত বিষয়ে মৃত অঞ্জলি মালাকারের স্বামী সনজিত গত ১৯/০৩/২০২১ খ্রিঃ তারিখ বাহুবল মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা আসামী/আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলে বাহুবল মডেল থানার মামলা নম্বর-০৫, তারিখ-১৯/০৩/২০২১ খ্রিঃ, ধারা-৩০২/৩৯৪/৩৪ দঃ বিঃ রুজু করা হয়। মামলার তদন্তভার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) জনাব আলমগীর কবির এর উপর অর্পণ করা হয়। তদন্তকালে ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে উক্ত বাড়ির দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া আমির হোসেন (৩০), পিতা-আলমগীর, সাং-চৌকিদিঘী, থানা-শাহ্পরান, জেলা-এসএমপি, সিলেট, বর্তমান ঠিকানা জনৈক আব্দুল মুমিন তালুকদার এর দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া দিগম্বরপুর বাজার, বাহুবল, হবিগঞ্জ’কে গত ১৯/০৩/২০২১ খ্রিঃ তারিখ গ্রেফতার করা হয়।
ঘটনা তদন্তকালে ও আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অত্র মামলার বাদী সনজিত এবং সে পূর্ব পরিচিত। তাহারা দু’জন একসাথে লেবারের কাজ করত। সনজিতের রেফারেন্সে অনুমান ৩ মাস পূর্বে উক্ত বাসার দ্বিতীয় তলার বাসা ভাড়া নেয়। সে উক্ত বাসাতে স্ত্রী ও ছেলে মেয়েসহ বসবাস করত। কিছুদিন পূর্বে তার টাকার প্রয়োজন হলে সে সনজিতের বাসাতে এসে ০৩ হাজার টাকা ধার নেয় এবং সে তখন জানতে পারে সনজিতের ঘরে প্রায় ০২ লক্ষ টাকার মতো রয়েছে। উক্ত টাকাগুলি এবং ঘরে থাকা স্বর্ণালঙ্কার চুরি করার জন্য সে মতলব করতে থাকে।
এ বিষয়ে সে তার এক ঘনিষ্ট সহযোগির সাথে আলোচনা করে। গত ১৮/০৩/২০২১ খ্রিঃ তারিখ সনজিত কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য সুনামগঞ্জে যায় এবং তার ফিরতে সকাল হবে সে জানতে পারে। সনজিত বাড়িতে না থাকার সুবাদে সে টাকাগুলি নেয়ার জন্য তার সহযোগি মনির মিয়া (৪৭), পিতা-মৃত মহিদ উল্লাহ্, সাং-নোয়াঐ, থানা-বাহুবল, জেলা-হবিগঞ্জ এবং অন্য একজন সহযোগির সাথে ঐদিনই পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক রাত অনুমান ১০.০০ ঘটিকার সময় তারা উক্ত বাসার মেইন সুইচ থেকে বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়ে পুরো বাসাটিকে অন্ধকার করে ফেলে। রাত অনুমান ০২.০০ ঘটিকার সময় তারা ০৩ জন উক্ত বাড়ির আমির হোসেন এর ঘরে একত্রিত হয়। সনজিত দাসের ঘরের দরজা খুলার জন্য আমির হোসেন কৌশল অবলম্বন করে। সে সনজিত এর স্ত্রী মৃত অঞ্জলি মালাকারের মোবাইল ফোনে রাত অনুমান ০৩.১০ ঘটিকার সময় কল দিয়ে বলে তার বাসায় চুরি হয়েছে এবং তার টিভি, সেলাই মেশিন চুরি করে নিয়ে গেছে। অঞ্জলি মালাকার যেন তার বাসায় এসে চুরির বিষয়টি দেখে এবং এটি বিশ্বাস করানোর জন্য আমির হোসেন একটি রশি উক্ত বাড়ির ছাদে বেঁধে অঞ্জলি মালাকারের বারান্দার সামন দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। অঞ্জলি মালাকার তার ঘরে না আসায় আমির হোসেন সঞ্জিতকে ফোন দিয়ে বলে আমার ঘরে চুরি হয়েছে অথচ তোমার স্ত্রী আমাকে দেখতে এলো না এবং সঞ্জিত বর্তমানে কোথায় আছে তা জানতে চায়।
সনজিত জানায় সে তখন সুনামগঞ্জে আছে। এরপর সঞ্জিত তার সহযোগিসহ তিনতলায় মৃত অঞ্জলি মালাকারের দরজার সামনে যায় এবং অঞ্জলি মালাকারের দরজায় টুকা দিয়ে দরজা খুলতে বলে। মৃত অঞ্জলি মালাকার তার কথায় বিশ্বাস করে দরজা খুললে তারা তিনজন ঘরে প্রবেশ করে অঞ্জলি মালাকারের মুখে চাপ দিয়ে ভিতরের কক্ষে নিয়ে যায় এবং তার মুখে ও শরীরে আঘাত করে তার গলাকেটে তাকে হত্যা করে।
এ সময় উক্ত ঘরে থাকা অঞ্জলি মালাকারের মেয়ে পূজা রানী দাস ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে কান্না করতে থাকলে তারা তাকেও গলাকেটে হত্যা করে।
এরপর তারা অঞ্জলি মালাকারের ঘরের ড্রয়ারে থাকা অনুমান ১ লক্ষ নব্বই হাজার টাকা ও অঞ্জলি মালাকারের ব্যবহৃত ০১ টি এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। তারা হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছোরা ও মোবাইল ফোনটি ঘটনাস্থলের পাশে একটি ডোবাতে ফেলে দেয়।
আমির হোসেন এর বাসায় চুরি হয়েছে এবং আমির হোসেনকে যাতে সন্দেহ না করা হয় সে জন্য সে তার বাম হাতের পাতায় নিজেই কাটা দাগ সৃষ্টি করে এবং ডাকাতরা তাকে মেরে বাড়ির পাশে একটি জমিতে ফেলে রেখে গেছে বিশ্বাস করার জন্য সে অজ্ঞান হওয়ার ভান করে জমিতে পড়ে থাকে।
স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরবর্তীতে হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে প্রেরণ করেন। ধৃত আসামী আমির হোসেন এর স্বীকারোক্তি মতে এবং তদন্তকালে ঘটনার সাথে জড়িত মনির মিয়া (৪৭)’কে অদ্য ২০/০৩/২০২১ খ্রিঃ তারিখ বাহুবল মডেল থানা পুলিশ গ্রেফতার করে।
ধৃত আসামীদের দেখানো মতে ঘটনাস্থলের পাশে একটি ডোবা হতে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছোরা, লুন্ঠিত মোবাইল ফোন এবং কিছু টাকা ধৃত আসামীর ঘর হতে উদ্ধার করা হয়। অপর সহযোগি আসামীকে গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত আছে। আসামী আমির হোসেনকে বিজ্ঞ আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন।