মায়ের সাথে শক্তিশালী আবেগীয় বন্ধনে যুক্ত থাকা শিশুরা বেশি নিরাপত্তা বোধ নিয়ে বড় হয়।
আমাদের দেশে প্রবাদ আছে – “বাপকা ব্যাটা, সেপাইকা ঘোড়া”। প্রবাদ তৈরি হয় কাকতালীয় ঘটনা, প্রাকৃতিক ঘটনা এবং গুজবের ভিত্তিতে। উপরের এই প্রবাদের বৈজ্ঞানিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আধুনিক বংশগতিবিদ্যা বিষয়ক বিজ্ঞান। কারণ আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে সন্তানের গুণাবলী বিকাশ ও নির্ধারণে বাবার চেয়ে মায়ের জিনই বেশি কার্যকর বা বড় প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
আমাদের সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্যের বেশিরভাগটা তৈরি হয়েছে সন্তানের মঙ্গলানুষ্ঠান আর সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের ভালবাসাকে কেন্দ্র করে। সন্তানের সৌন্দর্য-বীরত্ব-কৃতিত্ব সবকিছুতে বাবার গুণের ছাপ থাকে বলে ধরে নেয়া হয়। কেননা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে ওঠা সন্তানেরা পরিচিত হয় বাবার পরিচয়ে। তাই এই সাধারণ ধারণাই প্রতিষ্ঠিত যে সন্তানরা সব সময় সবকিছু বাবার কাছ থেকেই পায় সেটা হোক গুণ বা দোষ। অথচ বাস্তবতা হল ভিন্ন। বরং সন্তানের বুদ্ধিমত্তার প্রায় সবটাই আসে মায়ের কাছ থেকে।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ
সাইকোলজি স্পট নামের একটি মর্যাদাপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ম্যাগাজিন এই গবেষণামূলক তথ্য সর্বপ্রথম প্রকাশ করে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের বংশগতি বিদ্যা বিভাগের গবেষকরা নব্বইয়ের দশকে একটি পরীক্ষা চালান মানব মস্তিষ্ক ও শরীর নিয়ে। প্রথমেই তারা আবিষ্কার করেন, শিশুরা বুদ্ধিমত্তার ৪০-৬০ শতাংশ পরিবার ও বংশ থেকে এবং বাকিটা পরিবেশ থেকে বড় হবার সময় অর্জন করে। এখন প্রশ্ন হল , এই ৪০-৬০ শতাংশ বুদ্ধিমত্তা সে কিভাবে অর্জন করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বুদ্ধিমত্তা বিকাশে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে এক্স ক্রোমোজোম। অর্থাৎ এক্স ক্রোমোজোমকে বলা হয় বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক জিনের বাহক। নারীদের শরীরে দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকে। তাই এটা সুস্পষ্ট যে, শিশুর দেহে বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টিকারী জিন মায়ের কাছ থেকেই বেশিরভাগটা আসে। কারণ নারীরা দুইটি এক্স ক্রোমোজোম বহন করেন। আর পুরুষের দেহে থাকে একটি এক্স ও একটি ওয়াই ক্রোমোজোম। বাবার কাছ থেকে যে অ্যাডভান্সড কগনিটিভ ফাংশন জন্ম সূত্রে শিশু লাভ করে, তার কার্যকারিতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় একসময়। বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জিন হল ‘কন্ডিশন্ড জিন’। মায়ের কাছ থেকে আসা এই জিন শিশুর দেহে কাজ করেতে থাকে। আর বাবার কাছ থেকে আসা জিনেরা অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। তাই বুদ্ধিমত্তার জন্য যে জিন দরকার তা মায়ের দেহ থেকে আসতে হবে। গবেষণাগারে জন্মানো ইঁদুরের ওপর একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। তাদের মস্তিষ্ক বড় করতে মায়ের বাড়তি জিন প্রয়োগ করা হয়। দেখা গেছে তাদের দেহের আকার ছোট হয়েছে এবং মস্তিষ্ক বড় হয়েছে। আর যেসব ইঁদুরের মাঝে বাড়তি বাবার জিন দেওয়া হয়েছিল তাদের মস্তিষ্ক ছোট এবং দেহ বড় আকারের হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেন, ইঁদুরের মস্তিষ্কের ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন অংশে বাবা ও মায়ের জিন কার্যকর হচ্ছে। বাবার জিন দেহের লিম্বিক সিস্টেমে মূলত কাজ করে। এই অংশটি সাধারণত সেক্স, খাবার ও আগ্রাসী মানসিকতা তৈরিতে কাজ করে। বিজ্ঞানীরা দেখেন সেরেব্রাল কর্টেক্সে বাবার কোনও জিন নেই, অথচ এই অংশই কগনিটিভ ফাংশনের কাজটুকু করে যা বুদ্ধিমত্তা তৈরি ও বিকাশে ঘটায়।
তবে ইঁদুর আর মানুষের মস্তিষ্কের কিছু ভিন্নতা রয়েছে। তাই গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক মানুষের উপরই গবেষণা চালিয়েছে বিষয়টি নিশ্চিত হবার জন্য। তারা ১৯৯৪ সাল থেকে ১৪-২২ বছর বয়সী ১২৬৬৮ জন নারী পুরুষের মস্তিষ্ক ও দৈনন্দিন জীবন নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। এতেও দেখা গেছে মায়েদের কিংবা নারীদের আই কিউ লেভেল অনেক ভাল। এবং যেসব পুরুষদের আই কিউ লেভেল ভাল তাদের সেরেব্রেল কর্টেক্সেও মায়ের জিনই রয়েছে।
এই গবেষণায় দেখা গেছে শুধু মায়ের কাছ থেকে আসা জিনের কারণেই নয়, মায়ের সাথে শক্তিশালী আবেগীয় বন্ধনও শিশুদের বুদ্ধি বিকাশে সহায়তা করেছে। এই বিষয়টি অবশ্য ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও নিশ্চিত করেছে। তাদের মতে, মায়ের সান্নিধ্য শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে অপরিহার্য। কয়েক হাজার শিশুর জন্মের পর থেকে মায়েদের উপর করা ৭ বছরের এই গবেষণাটি দেখিয়েছে, মায়ের সান্নিধ্যে থাকা শিশুদের ১৩ বছর বয়সে মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস নামের একটি অংশ ১০ শতাংশ বড় হয় যারা মায়ের সান্নিধ্যে কম থাকে সেই শিশুদের তুলনায়। মস্তিষ্কের এই অংশটি স্মৃতি, শেখার ক্ষমতা ও চাপ ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত। মায়ের সাথে শক্তিশালী আবেগীয় বন্ধনে যুক্ত থাকা শিশুরা বেশি নিরাপত্তা বোধ নিয়ে বড় হয়, ফলে তারা সাহসী হয় এবং তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা বেশি থাকে। আর যখন মায়েরা শিশুদের প্রয়োজনীয় সময়ে মনোযোগ দেন এবং সমস্যা সমাধানে সহায়তা করেন কিংবা কোন কাজ যৌথভাবে করে সন্তানের সাথে, তখন শিশুরা নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য ও গুণ আবিষ্কার করে এবং এর বিকাশ ঘটাতে শেখে।
তবে আরেকটি আশ্চর্যজনক তথ্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, আর তা হল শিশুর মস্তিষ্কের যে অংশের জন্য তারা বেশি আবেগী ও অনুমান (Intuition) ক্ষমতাসম্পন্ন হয় সেই অংশ বাবার কাছ থেকে পাওয়া জিনের কারণেই কার্যকর হয়। অর্থাৎ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা তৈরিতে আবার বাবার জিনের ভূমিকা বেশি। তাই বাবা যে শিশুর বুদ্ধিমত্তা বিকাশে একেবারে কোন কাজে আসেনা, তা ঠিক নয়।
তবে মায়ের জিন এবং ভালবাসা ছাড়া যে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ পূর্ণভাবে ঘটেনা, এটা এখন সত্য। তাই নারী কিংবা মায়েদের বদৌলতেই আসলে সভ্যতার এত উতকর্ষ ঘটেছে, তা নিশ্চিত। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘’আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো”। নেপোলিয়নও অন্তত নারীদের শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। পশ্চাৎপদ ও নারী-পুরুষ সমতায়ন ও ক্ষমতায়নে অবিশ্বাসীদেরও এই উপলব্ধি হওয়াটাও এখন সময়ের দাবি।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ফোর্বস ম্যাগাজিন, বাংলাদেশ প্রতিদিন, যুগান্তর।
পোস্ট সূত্র : তারামন বিডি.কম ।
লেখক :