জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

আগাম ফসল উঠানোর ঝুঁকি নিয়ে ভাবতে হবে

শাহ ফখরুজ্জামান: উন্নত বিশ্বে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের সবারই কম বেশি জানা আছে। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আগাম ফসল ফলানোর মাধ্যমে লাভবান হওয়ার একটি সংস্কৃতি আমাদের কৃষিতেও গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে শীতকালীন সবজি আবাদে এটি চোখে পড়ছে বেশি।

আগাম সবজি আবাদে অনেক কৃষক নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন। বাজারে সবজির সরবরাহ বেড়েছে। ক্রেতাদেরকে বৈচিত্র উপহার দিচ্ছে। কিন্তু এবার আমাদের কৃষিতে নিরবেই যে বিষয়টি চলছে সেটি হল আগাম সবজি আবাদ নয়। বরং সেটি হল আগাম সবজি আহরণ। এর যে সদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাজার সরবরাহে এ নিয়ে কেউ ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না।

আমাদেরকে কমবেশি সবাইকে বাজারে যেতে হয়। যারা নিয়মিত বাজারে যান তারা যদি একটু গভীরভাবে অনুসন্ধান করেন তাহলে যে জিনিসটি চোখে পড়বে সেটি হল এবার আলু এবং পেঁয়াজের দাম ও সরবরাহের বিষয়টি। এই দুটি ফসল আমাদের ভোক্তাদেরকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। রাজনীতির মাঠ কাপানোতেও থাকে এই ফসলের। পণ্যদুটির দাম বাড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় জনসাধারনের মাঝে। কিন্তু এ নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা বা এর সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কেউই চিন্তা করছেন না বলে আমার মনে হচ্ছে।

সংরক্ষণ, বাজারে সরবরাহ, অতিরিক্ত ফলন হলে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষকদেরকে সুরক্ষার বিষয়টি কোনসময়ই নিশ্চিত করা হয়নি।

মৌসুমের এই সময়ে আলু, পেঁয়াজের এই উচ্চ মূল্যের পেছনে অবৈধভাবে দাম বাড়ানোর কারসাজি কাজ করছে কিনা সেটি নিয়ে কেউ ভাবছেন না। তবে এর পিছনে কোন কারণ আছে কিনা তা খুঁজে বের করতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বাণিজ্যসচিবকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।স্বার্থের এক রিট আবেদনে প্রাথমিক শুনানির পর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি আতাবুল্লার হাইকোর্ট  রবিবার ২৮ জানুয়ারী রুলসহ এ আদেশ দেন।

কৃষিসচিব, বাণিজ্যসচিব, অর্থসচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চেয়ারম্যানকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আলু, পেঁয়াজের মতো কৃষিপণ্য ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সম্প্রতি  বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর-প্রতিবেদন যুক্ত করে জনস্বার্থে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। এই রীটটি অত্যন্ত সময়উপযোগী হয়েছে।

শীতের আগমনের সাথে সাথে আমাদের কৃষকরা যারা আগাম আলু এবং পেঁয়াজের আবাদ করেন তাদের ফসল বাজারে আসতে থাকে। নতুন আলুর ভাল দাম পাওয়া যায় বলে কষ্ট এবং ঝুকি নিয়ে কৃষকরা আগাম ফসল ফলান।

এক পর্যায়ে নিয়মিত ফসল উঠতে থাকলে দাম চলে আসে সবার নাগালে। এমনকি কৃষক ক্ষতির মুখেও পড়ে যান কোন কোন মৌসুমে। আগাম নতুন আলুর দাম কেজিতে ১০০টাকার উপর থাকে বেশকয়েকদিন। পরে মৌসুমী আলু উঠতে থাকলে তা ১০টাকার নিচেও আসে কোন কোন সময়।

পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও আগাম পেঁয়াজ বিগত মৌসুম শেষের উচ্চ মূল্য কমানোর প্রতিযোগিতায় নেমে নিজেও বিক্রি হয় উচ্চ মূল্যে। সেঞ্চুরির  ঘর থেকে নেমে আসে ২০টাকা কেজিতে। কিন্তু এ বছর এই ফর্মুলাটি কাজ করছে না বাজারে। আগাম জাত শেষ হওয়ার পরও দাম কমার কোন লক্ষণ নেই বাজারে। আর এই সুযোগে কৃষকরা এখন ফসল পরিপক্ষ হওয়ার আগেই ভাল দাম পাওয়ার আসায় অপর পক্ষ ফসল নিয়ে আসছেন বাজারে।

এতে কৃষকরা লাভবানও হচ্ছেন। এর চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ও বাজার কারসাজির সাথে জড়িতরা।

একটি জমিতে যদি আলু পরিপক্ষ হওয়া পর্যন্ত কৃষক অপেক্ষা করেন তাহলে প্রতি বিঘায় ১হাজার কেজি আলু উৎপাদন করতে পারেন। কিন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে অপর পক্ষ ও ছোট আলু কৃষকরা সরবরাহ করছেন। এতে করে যে জমিতে ১হাজার কেজি আলু উৎপাদন হওয়ার কথা সেই জমিতে আলু উৎপাদন হচ্ছে ৫০০/৬০০ কেজি। কিন্তু পরিপক্ষ আলু উৎপাদন করলে আরও বেশি সময় মাঠে পরিচর্যা করতে হবে এবং বেশি ফসলে যে দাম পাওয়া যাবে তার চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে সেই ৫০০/৬০০ কেজিতেই। তাই কৃষকরা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি না হয়ে পরিপক্ষ হওয়ার আগেই উঠিয়ে ফেলছেন ফসল।

এখন বাজারে ৪০/৫০টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে আলু। পরিপক্ষ হলে বিক্রি হতে পারে ১০/১৫টাকা কেজি; সেই হিসাব থেকেই কৃষকরা এমনটি করছেন।
অন্যান্য বছর মৌসুমের এই সময়ে পেঁয়াজের ২০/৩০টাকা কেজিতে চলে আসত। কিন্তু এ মৌসুমে এখনও দাম ৭০/৮০টাকা কেজি। কৃষকরা তাই পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও অপর পক্ষ ফসল তুলে বিক্রি করে ঘরে মুনাফা তুলে নিচ্ছেন।

আমাদের এখানে উচ্চ মূল্য নিয়ে অনেকেই অনেক কারণ এর কথা বলেছেন। কিন্তু ভারতে চিকিৎসার কাজে যাওয়া হবিগঞ্জের সিনিয়র সাংবাদিক হারুন ভাই বলেন, ভারতে কোন  সবজির দাম ৩০টাকা কেজির বেশি নয়।

ভারত ফেরত অনেকেই বলেছেন, সেখানে চিনির কেজি ৬০টাকা কেজি এবং পেঁয়াজের মূল্য ২০টাকা কেজি। কিন্তু বাংলাদেশে কেন মূল্যের এই তারতম্য তারও কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

কৃষকরা আগাম ফসল উঠাতে যেভাবে মনোযোগ দিচ্ছেন সেটি অব্যাহত থাকলে এবার আমাদের দেশের কোল্ড স্টুরেজগুলোতে কোন আলুর সরবরাহ থাকবে কিনা সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। পেয়াজের গুদামগুলোও শুন্য থাকে কিনা সেটি দেখতে হবে।

কৃষি বিভাগ, বাজার কর্মকর্তা আর প্রশাসন যদি এখনই মাঠে না নামে তাহলে বড় ধরনের ভোগান্তির মুখে পড়তে হতে পারে আমাদেরকে। বিশেষ করে সামনের রমজান মাসে এই দুটি ফসলের অনেক চাহিদা থাকবে।

এবারের রোজা ফসল দুটির ভর মৌসুমে হলেও বাজারের লক্ষণ থেকে অনুমান করা যায় ঝুকি আছে অনেক।

আমাদের জনগণ বিচার বিবেচনা না করেই অনেক কাজ করেন। যার প্রভাব খারাপই হয় সব সময়। প্রকৃতি আর সম্পদ ধ্বংস করার ক্ষেত্রে আমারা নিজেরাই দায়ী। আর ধ্বংসের মাত্রা যখন আমরা চরম পর্যায়ে পৌছাই তখনই সরকার হস্তক্ষেপ করে। আইন তৈরি করে। তারপরও আমরা আইন না মানার মধ্যেই থাকতে পছন্দ করি। উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি আমাদের প্রাকৃতিক মিঠা পানির মাছের কথা।

ইলিশ মাছের কথাও বলা যায়। আমরা যখন নির্বিচারে পোনামাছ নিধন করতে শুরু করি তখন সরকার আইন করে সেটি নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করছে। ঝাটকা শিকার থেকে রক্ষার জন্য ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ইলিশ শিকার বন্ধ রাখছে। আমার মনে হচ্ছে মাছের ফর্মুলাটি কৃষিতেও ব্যবহার করার সময় হয়েছে।

একটি উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই। আমাদের দেশে দিন দিন কাচা আমের চাহিদা ও দাম বাড়ছে। পাকা আম ৩০/৪০টাকা কেজি হলেও অনেক সময় কাচা আম ২০০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হয়। এখন যদি কাচা আমের এই উচ্চ মূল্য পাওয়ার আশায় আম বাগানের মালিকরা কাচা আম বিক্রি করতে থাকেন তাহলে পাকা আমের কি হবে? পেঁয়াজ এবং আলুর ক্ষেত্রে এবার এমনটিই হচ্ছে।

কৃষি বিভাগের হাতে নিশ্চয় পরিসংখ্যান রয়েছে আমাদের দেশে কি পরিমাণ আলু ও পেঁয়াজ প্রয়োজন। আর আবাদ হয়েছে কতটুকু। আবার আবাদকৃত ফসল যদি যথাসময়ে না তুলে আগাম তুলা হয় তাহলে উৎপাদনের কি অবস্থা হবে।

এই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে আলু ও পেঁয়াজের আবাদ থেকে উঠানোর সময় নির্ধারন করে দেয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে পরিপক্ষ ফসল তুলতে গিয়ে যদি কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হয় সরকার যাতে তাদেরকে ভর্তুকী দেয় সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যাতে কারসাজি না করতে পারে সেটিও দেখতে হবে। আর না হলে কিছুদিন আগেও আমরা ধান ও আলু রপ্ত কথা বলে আসলেও এখন আমদানীর দিকে ঝুকতে হবে।

পেঁয়াজ ও ভৌজ্যতেলে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও আগাম উত্তোলনের কারনে উৎপাদন ঘাটতি বেড়ে গিয়ে এলসিতে ডলারের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবার সময় হয়েছে বলে আমি মনে করি।

লেখকঃ
সাংবাদিক ও আইনজীবী