হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার ৬নং কাগাপাশা ইউনিয়নের অন্তর্গত মাকালকান্দি একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম।উপজেলার একটি দূর্গম হাওর অঞ্চলে অবস্থিত গ্রামটিতে ১৯৭১ সালের ১৮ আগষ্ট নির্বিচারে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী, পুরুষ, শিশু সহ প্রায় ১২৫ জনকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।
এ উপলক্ষ্যে প্রতিবছরই এই দিবসটিতে ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানান স্থানীয় এলাকাবাসী ও উপজেলা প্রশাসন।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর পরই পাকহানাদার বাহিনী বানিয়াচংয়ে প্রবেশ করে। এবং তারা বানিয়াচং রাজবাড়ীতে বসে রাজাকারদের সঙ্গে সলাপরামর্শ বৈঠক করে।
বৈঠকের খবরটি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে আজমিরীগঞ্জের দাস পার্টির প্রধান শহীদ জগৎজ্যোতি দাস ও বানিয়াচংয়ের রমেশ চন্দ্র পান্ডের সমন্বয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গেরিলা বাহিনীর প্রতিরোধ দূর্গ গড়ে তোলেন। তারা উপজেলার প্রায় সবকটি এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনেন।
১৫ ই আগষ্ট ১৯৭১ সালে বানিয়াচং রাজবাড়ীতে পাকিস্তানী মেজর দুররানী খানের নেতৃত্ব একদল পাক সৈনিক কিভাবে হত্যাকান্ড পরিচালনা করবে তা নিয়ে আবারো ২য় বারের মতো শান্তি কমিটির সাথে বৈঠকে মিলিত হয়।
পরে ১৮ আগষ্ট মাকালকান্দি গ্রামে গণহত্যার পরিকল্পনা চুড়ান্ত করা হয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর দুররানীর নেতৃত্বে ১৮ আগষ্ট ভোরে পাকহানাদারদের ১৬টি নৌকা বোঝাই সৈনিক ও রাজাকার কমান্ডার আব্দুর রহমানের নেতৃত্ব আরো চারটি নৌকায় রাজাকার বাহিনী প্রচুর বৃষ্টির মধ্যে মাকালকান্দি গ্রামে রওয়ানা দেয়। সকাল ৭টার মধ্যে হায়েনারা ওই গ্রামে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
সকাল বেলা গ্রামের চণ্ডি মন্দিরে মনসা ও চণ্ডি পূজার প্রস্তুতি চলছিলো। এ সময় পাকহানাদার ও রাজাকার বাহিনীর মোট ২০টি নৌকা এসে গ্রামে হামলা চালায়। এসময় পূজারত নারী-পুরুষদের চণ্ডি মন্দিরের সামনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে নির্মমভাবে গণহত্যা করা হয়। মূহুর্তের মধ্যে রক্তে লাল হয় পূজার ফুল। এতে একই পরিবারের ১১ জন ও নারী, পুরুষ,শিশুসহ মোট ১২৫ জন গ্রামাবাসী প্রাণ হারান।
হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাক বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় খাদ্য ভাণ্ডারে সমৃদ্ধশালী গ্রাম মাকালকান্দি থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণ অলংকারসহ সমস্ত সম্পদ লুটে নেয়।যাবার সময় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ঘরবাড়ি।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে চারদিনের শিশু পর্যন্ত রেহাই পায়নি হায়েনার হাত থেকে। মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বেওনেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। শিশুটির মা হৃদয় বিদারক সেই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন আজও।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বানিয়াচং থেকে পাক-হানাদার মুক্ত হলে স্থানীয় রাজবাড়ীর আলী রাজা ও ইয়াহিয়া রাজা মহিলাদের বোরকা পড়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে গিয়েছিলো।মুক্তিবাহিনী ও বিক্ষুব্ধ জনতা রাজবাড়ীতে অগ্নি সংযোগ করে সব কিছু পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর মাকালকান্দি বধ্যভূমি ৩৬ বছর অযত্নে অবহেলায় পড়েছিল।২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট গণহত্যা দিবসে উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী কর্মকর্তা নুরে আলম সিদ্দিকীর উদ্যোগে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে দিবসটি পালন করছে স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসন।।
আজ ১৮ আগষ্ট ২০২১ এলাকাবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে ৩৩ লক্ষ ২৯ হাজার টাকা ব্যায়ে মাকালকান্দিতে নির্মিত নতুন স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করবেন এমপি আব্দুল মজিদ খান৷