আল-আমিন আহমেদ’ জীবনঃ পথশিশু হলো সেসব শিশু, যারা দারিদ্র্য, গৃহহীনতা বা উভয়ের কারণে শহর, নগর বা গ্রামের রাস্তায় বসবাস করছে। আমাদের দেশে এ পথশিশুদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মূলে রয়েছে অজ্ঞতা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাব।
আমাদের দেশে একশ্রেণির অশিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষ রয়েছে, যারা অপরিকল্পিতভাবে শিশুদের জন্ম দিয়ে থাকে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের পরিত্যাগ করে, ভরণপোষণ দেয় না। সেই শিশুরাই আবার অনেক সময় টোকাই বা পিচ্চি নামে পরিচিত হয়। খালি গায়ে, খালি পায়ে কিংবা ছেঁড়া জামাকাপড় পরে রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও শহরের অলিগলি এলাকায়ই এদের বিচরণ।
আবার রাতের বেলায়ও যেখানে-সেখানে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অর্থাৎ এদের জীবনটা হচ্ছে, “যেখানে রাত, সেখানেই কাতের মতো।” কোনো ট্রেন ছাড়ার আগে ছোট-বড় ব্যাগ নিয়ে ছুটতে দেখা যায় তাদের। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বোতল, পলিথিন, কাগজসহ মানুষের ব্যবহৃত ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র কুড়ানো ও ভিক্ষার মাধ্যমেই চলে তাদের দৈনন্দিন জীবন।
তাছাড়া রাস্তার পাশে জেগে ওঠা আবর্জনার স্তূপ, বাস টার্মিনাল-রেলস্টেশন এখানে-সেখানে নোংরা-অপরিচ্ছন্ন স্থানটুকুই আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয় ওরা। ওরা যেন সমাজের সর্বোচ্চ অবহেলিত মানুষ। কিন্তু এদের কেন এ অবহেলিত জীবন আর এর দায়ভারই বা কার?
জাতিসংঘের শিশু সনদ ও আমাদের দেশের আইন ২০১৩ অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সিদের শিশু বলা হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য মতে, বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৪৫ ভাগ শিশু। যার ৪০ শতাংশ শিশু বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে।
বাংলাদেশে এখন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৭৯ লাখেরও বেশি। তাদের কর্মস্থল হচ্ছে বাসস্ট্যান্ড, ফেরিঘাট বা রেলস্টেশন।
গত দশক থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার বিস্ময়কর উন্নতি সাধিত হয়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, রিজার্ভ ব্যাংক ফুলে উঠেছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি নামক পাখিও তর তর করে বেড়ে চলেছে। কিন্তু এত সব অর্জন কোনো কাজে আসেনি সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের।
দিন দিন বেড়েই চলছে এ সংখ্যা। যে শিশুরা শৈশব আর কৈশোরের অবাধ স্বাধীন জীবনকে বিসর্জন দিয়ে দুমুঠো ভাতের জন্য পথে পথে ঘুরছে, স্বল্প মজুরিতে অমানুষিক ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম দিচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের কারণে অল্প বয়সেই শরীরে নানারকম রোগের জন্ম দিচ্ছে, অনেকেই অকালে প্রাণও দিচ্ছে। তাদের কাছে রিজার্ভ ব্যাংক আর প্রবৃদ্ধি ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ৩৪ ও ৩৫ অনুযায়ী, ১৪ বছরের কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না। সেখানে আরও বলা হয়েছে, শিশুর বাবা-মা কিংবা অভিভাবক শিশুকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য কারও সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারবে না। কিন্তু এসব নীতিকে পাশ কাটিয়েই শিশুদের নিযুক্ত করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে।
আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে শিশুদের অভিভাবকরাই শিশুদের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কাজ করতে পাঠাচ্ছেন। যে বয়সে এ শিশুদের যাওয়ার কথা ছিল স্কুলে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেলার মাঠে উৎসবে মেতে ওঠার কথা, সেই বয়সে তাদের নামতে হচ্ছে জীবনযুদ্ধে। আমরা সবাই জানি অভাবের তাড়নায় আর পেটের দায়ে এরা সবাই জড়িয়ে পড়ছে অপরাধ জগতে, মাদকের জগতে।
বাংলাদেশে যত ছিনতাইয়ের ঘটনা বা রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে তার মূলে এদের রয়েছে প্রত্যক্ষ ভূমিকা। গাড়িতে আগুন দেওয়া, বোমা মারা বা ভাঙচুর করার মতো কাজগুলো একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতা এদের দিয়েই করিয়ে থাকেন।
৪০০ বা ৫০০ টাকার জন্য এরা মানুষ খুন করতে পারে অবলীলায়। শৈশব থেকেই অন্ধকার অনিশ্চিত একটা পৃথিবীর দিকে তাদের যাত্রা শুরু হয়, আর সেই অবহেলিত অন্ধকার জীবন তথা এমন দুর্বলতার সুযোগ নেয় নষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতারা।
এত বিপুলসংখ্যক একটা জনগোষ্ঠীকে খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানসহ নিরাপদ একটা শৈশববঞ্চিত করে কি আলোকিত একটা বাংলাদেশ হবে? এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে কোনো দল বা সরকারের কোনো কালে এতটুকু মাথাব্যথা দেখিনি।
কানাডাসহ অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রে বাবা-মায়ের চেয়ে সন্তানদের দেখভাল করার দায়িত্ব বেশি সরকারের। সেখানে সন্তান জন্মের পরই তার ভরণপোষণ বা লালন-পালনে কোনো অবহেলা করা হচ্ছে কি না তার জবাবদিহি বাবা-মাকে সরকারের কাছে করতে হয়।
আর আমাদের দেশে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। তারা যে মৌলিক অধিকারগুলো পাওয়ার কথা, সেগুলোর শতকরা ৯০ ভাগ থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ একটু পরিকল্পনা মাফিক আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে কয়েক বছরের মাঝেই এ পথশিশু শূন্যের কোটায় আনা সম্ভব।
শিক্ষাবঞ্চিত, সমাজ সভ্যতার তিমিরে নিমজ্জিত এসব ছিন্নমূল টোকাই-পিচ্চিদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ওদের মেধা ও শ্রমের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটিয়ে দেশের সম্পদে পরিণত করা সম্ভব।
এজন্য প্রথমেই প্রতিটি জেলায় না হোক অন্তত বিভাগীয় শহরগুলোতে সরকারি ও বিত্তবানদের অর্থায়নে মোটামুটি মৌলিক অধিকারগুলো অর্থাৎ খাদ্য, শিক্ষা, বস্ত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি নিশ্চিত করে একটি করে পথশিশু সেন্টার গড়ে তুলতে হবে, আর মেগা সিটিগুলোতে (ঢাকা ও চট্টগ্রাম) একের অধিক সেন্টার গড়ে তুলতে হবে।
শুনেছি রিজিকের মালিক মহান আল্লাহ্। আমি বিশ্বাস করি রিজিকের মালিক মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন। তাই বলে সন্তান একটি হলে অনেক ভালো আর দুটি সন্তানের অধিক আর সন্তান নয় এরকম মনোভাব নিয়ে সবাই যদি এগোয় তাহলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকতো। আসুন সবাই মিলে ‘পথশিশুর’ পাসে দাঁড়াই তাহলে আমাদের দেশে আর আর অসহায় শিশু থাকবে না।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে দাড়াই হয়তো ভবিষ্যতে এইসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাবে। যখন দেখি ধনী ঘরের কোন শিশু ৩ বেলা ভালো ভালো খাবার মুখের সামনে পেয়েও সেই খাবার খেতে আপত্তি করে আবার যখন দেখি দরিদ্র পিতা-মাতার কোন শিশু একবেলা খাবারের খোঁজে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় তখন মনটা ব্যথায় ভঁরে উঠে।
পথশিশুদের আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠলে ঠিকানাহীন নিরাশ্রয় এসব শিশু মানুষ হবে। উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়াতে এরাও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। দেশে নতুন করে আর কোনো আলোচিত টোকাই সাগর, পিচ্চি হান্নানের মতো সন্ত্রাসী সৃষ্টি হবে না।
লেখক: সাবেক ছাত্র, হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ