জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

এপ্রিল ফুলঃ ইতিহাস কী বলে? মুফতি তাকী উসমানী

আজ পহেলা এপ্রিল। এপ্রিল ফুল নিয়ে চমকপ্রদ কাহিনি সমাজে প্রচলিত আছে। ইংল্যান্ডের রাজা ফার্ডিন্যান্ড আর রানী ইসাবেলা কর্তৃক মুসলিমদেরকে মসজিদ আটকে দিয়ে অগ্নি সংযোগ এবং সমুদ্রে নৌকা ডুবি হত্যার নৃশংস অথচ রসালো গল্প সমাজে বহুল প্রচলিত। বলা হয় সেদিন মুসলিম গণহত্যার মাধ্যমে তাদের বোকা বানিয়ে এ দিনটির উদ্ভাবন হয়।

কিন্তু আসলে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুল ইতিহাস নির্ভর। যার গ্রহণযোগ্য কোন ভিত্তি নেই। এটা লোকেমুখে প্রচলিত একটি রসালো গল্পমাত্র।

আমি নিজেও একটি সময় তা লিখেছি এবং সেরকমই জানতাম।!

স্পেনের ইতিহাস নিয়ে সুবাস্তিত তথ্য নির্ভর আলোচনা করেছেন বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠতম ইতিহাসবিদ ডক্টর রাগিব সারজানি। তিনি ” কিসসাতু আন্দালুস ” তথা আন্দালুসের ইতিহাস নামক গ্রন্থে গ্রাণাডার পতন স্পেনের সমস্ত রকম আলোচনা করেছেন। সেখানে কোথাও এধরণের চুল পরিমাণ বর্ননা নেই।

বর্তমান শতাব্দির শ্রেষ্ঠতম ফক্বিহ জাস্টিস আল্লামা তাক্বি উসমানী হাফিজাহুল্লাহ তার গ্রন্থ ” যিকির ও ফিকির ” গ্রন্থের ৬০-৭০ পৃষ্ঠায় লম্বা আলোচনা করেছেন। যেখানে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

এপ্রিল ফুল পালনের প্রধান ও বিশুদ্ধ কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত বিশ্বকোষ ইন্সাইক্লোপেডিয়া অব লারূস বর্ণনা করেছে এবং এটাকেই যথার্থ কারণ বলে সাব্যস্ত করেছে। তা হল, প্রকৃতপক্ষে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বর্ণনানুপাতে ১লা এপ্রিল হচ্ছে সেই তারিখ যে তারিখে ইহুদি এবং রোমানরা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে ঠাট্রা-বিদ্রূপের পাত্র বানিয়েছিল। বর্তমানে প্রচলিত নামসর্বস্ব ইঞ্জিলগুলোর মধ্যেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। এ সম্পর্কে লুক-এর ইঞ্জিলের ভাষ্য এরকম—

‘যে ব্যক্তি তাঁকে (ঈসা আলাইহিস সালামকে) বন্দি করে রেখেছিল সে তাঁকে মারধর করত। তাঁর সঙ্গে ঠাট্রা-বিদ্রূপ করত। চোখ বন্ধ করে তাঁর গালে চড়-থাপ্পড় মারত এবং তাঁকে এই বলে জিজ্ঞেস করা হত যে, নবুওয়ত বা ইলাহামের মাধ্যমে বল, তোমাকে কে মেরেছে? এভাবে বিদ্রূপ করে আরো অনেক কথা বলা হত। (লুক ২২: ৬৩-৬৫)

ইঞ্জিলসমুহে একথাও আলোচনা করা হয়েছে যে, প্রথমে ঈসা আলাইহিস সালামকে ইহুদিদের নেতা ধর্মীয় পণ্ডিতদের উচ্চ আদালতে পেশ করা হয়। তারপর সেখান থেকে তাঁকে পিলাতোসের আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। পিলাতোস তাঁকে হিরোডোসের আদালতে পাঠিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত হিরোডোস তাঁকে বিচারকার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে পিলোতোসের আদালতে প্রেরণ করে।

লারূসের ভাষ্য হল, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে এক আদালত থেকে অন্য আদালতে এভাবে প্রেরণ করার উদ্দেশ্য তাঁর সঙ্গে পরিহাস করা এবং তাঁকে পীড়া দেয়া। আর এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল ১লা এপ্রিলে, তাই এপ্রিল ফুলের প্রথা মূলত এই লজ্জাজনক ঘটনার স্মৃতি।

এপ্রিল ফুল পালন করতে গিয়ে যাকে নির্বোধ বানানো হয়, ফরাসি ভাষায় তাকে বলা হয় Poisson davril ইংরেজি অর্থ হল, April Fish অর্থাৎ, এপ্রিলের মাছ। (ব্রিটানিকা, খ ০১ পৃ ৪৯)

এর মানে যাকে ১লা এপ্রিলে বোকা বানানো হয় সে যেন এপ্রিলের সুচনায় প্রথম শিকারি মাছ। তবে লারূস তার উপরোক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে একথাও বলেছে, Poisson শব্দটি- ইংলিশে যার অর্থ হয়, Fish তথা মাছ- মূলত এধরণেরই আরেকটি ফরাসি শব্দ Posion এর বিকৃত রূপ। যার অর্থ পীড়া দেয়া, শাস্তি দেয়া। আর খ্রিষ্টানদের বর্ণনা মতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে যে কষ্ট ও শাস্তি দেয়া হয়েছিল, মূলত তারই স্মারক হিসেবে প্রথাটি উদযাপন করা হয়ে থাকে।

অপর এক ফরাসি লেখক বলেন, Poisson শব্দটি তার মূল রূপেই আছে। তবে মূলত শব্দটি পাঁচটি শব্দের প্রথম শব্দ দ্বারা গঠন করা হয়েছে। ফরাসি ভাষায় যে শব্দগূলোর অর্থ হয় যথাক্রমে- ঈসা, মসীহ, আল্লাহ, বেটা, ফিদয়া। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ফরিদ ওয়াজেদিকৃত আরবি ইন্সাইক্লোপেদিয়া দায়েরাতু মাআরিফুল কুরআন পৃ২১, ২২, খ ১ দ্রষ্টব্য)

সুতরাং এ লেখকের মন্তব্যও যেন এই যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে কষ্ট দেয়া ও তাঁকে নিয়ে যে উপহাস খেলা হয়েছিল তারই স্মৃতিস্বরূপ এপ্রিল ফুলের উদযাপন।
ইতিহাসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুসলমানদের পরাজয়ের দিনটি ছিলো ১৪৯২ সালের ২ রা জানুয়ারি। এপ্রিলের ১ তারিখ বা এপ্রিল মাসেও নয়। তদুপরি এটা কতো সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা সে বিষয়েও কেউ সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেন না। এটা যদি ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১ লা এপ্রিল হয়ে থাকে তবে সম্পূর্ণই মিথ্যা একটি রটনা ছাড়া কিছুই নয়। কেননা ইতিহাসের সমস্ত দলিল-প্রমাণে খুব স্পষ্ট করেই লেখা রয়েছে যে, স্পেনে মুসলিমদের পরাজয়ের দিনটি ছিলো ২ রা জানুয়ারি ১৪৯২ এবং এর আগে ‘ট্রিটি অব গ্রানাডা’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যে চুক্তিনামায় খ্রিস্টানদের হাতে গ্রানাডার কর্তৃত্ব তুলে দেয়া সংক্রান্ত শর্তাদি লেখা ছিলো। তাহলে এপ্রিল ফুলের বিষয়টি এলো কোথা থেকে? যেখানে পরাজয় ঘটেছে জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে সেখানে এপ্রিলের ১ লা তারিখ কেনো আসবে তা কিছুতেই বোধগম্য নয়। নারকীয় হত্যাকাণ্ড যদি ঘটে থাকে তবে তাতো শহরে ঢোকার দিনই ঘটার কথা এবং আমাদের মাঝে প্রচলিত ইতিহাসও তাই বলে। কিন্তু আমরা সব ইতিহাসের দলিল-প্রমাণে দেখতে পাচ্ছি সেটি জানুয়ারির ২ তারিখ। তাহলে ১ লা এপ্রিলের বিষয়টি কোত্থেকে এলো?

সুতরাং বিষয়টি স্পষ্টত বোঝা ই যাচ্ছে যে এটি জনসমাগমে ভুল প্রসিদ্ধ গল্প। তা শোধরানো আপনার আমারই দায়িত্ব।

সুতরাং ভুল এবং বানোয়াট গল্প প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।

আল্লাহ আমাদের বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

” যিকির ও ফিকির : ৬৬-৭০ পৃষ্ঠা

কিসসাতু আন্দালুস : ৬৭০-৬৯০ পৃষ্ঠা
নাফহাতুত তিব্ব ৫২৫-৫২৬ পৃষ্ঠা