বোধের অহমজুড়ে শব্দচূর্ণ
জ্যোতিতে দ্রুতিতে পরিপূর্ণ
আপনার আরশ হতে ধার করি; টিকে থাকে আশ্রয়ে চির-ঋণ।
সূক্ষ্ম রুক্ষ দিনের ডানায়
পারিজাত বিচিত্র চিত্র মানায়
এ জগৎ ছেড়ে কত দূরে?
বহুদূরে মিশে থাকি অন্তহীন।
অমাবস্যায় হুতুমের ডাকাডাকি
গোরখোদক, শকুনের হাঁকাহাঁকি
সারসের বাংলায় ধানসিঁড়ি জল-
রক্তে ভাসে শারদীয়া রাত যতিহীন।
জীবনানন্দ, হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে মূর্তিময়ী একটি নাম। খুব নীরবে ছুঁয়ে থাকে, অনুভূতির স্তরে স্তরে সজীব, সজ্ঞান, সম্ভাবনা জাগ্রত মনন। দৈনন্দিনতাকে পূর্ণতা দান করে। অতীতকে ডেকে আনে আধো আধো ধোঁয়াশা কুটিরে। ভবিষ্যতের পুঁজি অতীত আর বর্তমান অথচ মুঠোভরা অন্ধকারের বেদনা। সেসব অন্ধকারে ভেঙে জেগে উঠে প্রেম। প্রকৃতির গভীর থেকে উঠে আসে আলোর ঝলক। টুকরো টুকরো জীবনের স্বাদ। আহা! শব্দ, দ্যুতি, বিন্যাস, স্বদেশ, প্রকৃতি। সজনে, শিমুল, আকন্দ, শালিক, হরিয়াল, মাছরাঙা, শঙ্খচিল, বক, সোনালি ডানার আশা, হেমন্তের গান, শিশিরের পায়ের শব্দ, ধানসিঁড়ি সবই এক জাদুর মশাল। আমাদের ঝাউবন, বুনোক্ষেত হাজার বছরের মিথ। ইতিহাসের পরতে পরতে গেঁথে থাকা জীবন বর্তমানের ঝাঁঝালো সময়ের বৈঠায় প্রাণ রাখা শীতল সরোবর। জীবনানন্দ শত বছরের বন্দনায় এক বাউল সংগীত। এ জীবন অতিতুচ্ছ, কচুপাতার জলের মতো টলমল, কচুরিপানার মতো দোলানো সংসার। সংঘাত ও সম্ভ্রমহানির জাগতিক কাসুন্দি সরিয়ে বোধের প্রগাঢ়তম প্রদেশে তীর্যক ঝাঁকুনি। নুয়ে থাকা নতুন বৃক্ষের মতো ডালপালা মেলে ধরে পথহারানো পাথর দঙ্গল।
পুকুরে ঝুলেথাকা ডাল, সোনাইলের জ্যোতি, কৃষ্ণচুড়া ফাগুন, গুনগুন গুঞ্জন একলা থাকার সঙ্গী। এখানে আমার চিরবাস, এখানেই ফিরে আসা। বাঁশবনের কথা, সরিষার হিল্লোল; আমার বসতভিটা, মায়ার সঙ্গম। আমার অহম, বোধ ও বিবেক, চেতনার প্রগাঢ় অনুভব। শিশিরের মতো ঝরে ছেঁড়া পাতার জীর্ণ কুটিরে। ওখানে ঠাঁই নাই; অস্তিত্বে ঘুনপোকা, অস্তিত্বে সর্পের সর্বনাশা বিষ। সে বিষে বেদনার কাল কেউটে হেঁটে যায়। আমিও প্রকৃতির মতো হতে পারি বিষনাশক, হতে পারি কলকল নির্ঝরিণীর সিঞ্চন, কিংবা অগ্নিগিরির প্রজ্বলন। বধিরতা ও অন্ধত্ব থেকে মুক্তি দাও ভোরের স্পর্শ, দিঘির ভাঁটফুল, বাটুই সন্ধ্যা। হে- আমার শৈশবের বাঁশের সাঁকো, কাঠের পুল- বিন্যস্ত পারাপার। পথ ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত পথিকের অশ্বত্থ মায়া। জীবন বাড়তে বাড়তে ভাঙে যত মূঢ় বাধার পাহাড়।
হৃদয় যখন অসাড় হয়ে উঠে, খরার বন্দনায় পৃথিবীতে কোরাস চলে। মুষড়েপড়া সময়ে স্বস্থির শ্বাস ছুটে আসে যার কবিতায়- তিনি জীবনানন্দ দাশ। যার কবিতার চরণ জীবন বাতাসে হেঁটে যায় আলোর জোনাকি হয়ে। ভারবাহী জীবনকে মগ্নতার গভীর দ্যোতনায় ঋদ্ধ ও প্রাণবাহী করে। অলঙ্কারের সুষমায়, অনুপ্রাস ও উপমায় হঠাৎ থমকে দেবার মতো চমকে দেয় নিপুণ বিন্যাস। কবি কবিতাকে পৃথিবী থেকে মহাপৃথিবীর দিকে ছুটিয়েছেন। প্রকৃতির নিগূঢ়তা অন্তরে প্রাণ সঞ্চিত করে গুপ্তবাণীর মর্মরতায় নিজেকে খুঁজে পেতে জীবনানন্দ দাশের কবিতাই সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল। বোধ ও মননের গভীরতম প্রদেশ নাড়িয়ে কবির কবিতা সজীবতার স্তব, তারুণ্য ও প্রজ্ঞাবোধ।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি। কবিতাকে শিল্পোর্তীর্ণ এক অনন্য পর্যায়ে তুলে ধরেছেন আর পূর্ণ করেছেন অগণিত পাঠক মনন। তাই তো যুগ যুগ ধরে, শতাব্দীর অন্যতম আধুনিক কবিতার শীর্ষ অবস্থান তাঁর একথা অকপটে বলা যায়। নতুন কলমে জাগরণ, অনুপ্রেরণা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও চেতনস্তর এক হয়ে তাঁর কবিতা উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল। জীবনের গভীরতম বোধ ও প্রেম-বিরহ আবেগ ও অনুভূতির সূক্ষ্ণ ধারায় পাঠকের প্রাণ মথিত হয়ে উঠে। নিজেকে খুঁজে পেতেই পাঠক তাঁর পঙক্তিমালার অবগুণ্ঠণ খোলেন। যেখানে মাইকেল মধুসূদন ও রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা ভাষা দীপ্তিমান। এখানে তিনি এক ও একক।
রূপকল্প, শব্দকল্প, চিত্রকল্প, অলঙ্কার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও মিথের চাদর বেষ্টিত ছন্দোবদ্ধ কবিতা বাংলার সৌন্দর্য, পুরাণ ও নষ্টালজিক অনুভূতির গভীর বেদনাবহ প্রশান্তি তাঁর কবিতা। নস্টালজিকতাকে বাস্তবের সাথে সমন্বিত করার আশ্চর্য স্বার্থকতা জীবনানন্দকে জীবনের কাছাকাছি ধরে রেখেছে৷ জীবন আনন্দময় নয়; জীবনের গভীরে প্রবাহমান বেদনার ধ্বনি চিত্রিত করেছেন অনন্য সূক্ষ্ণতায়। কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ লিখেছেন সবক্ষেত্রেই সফল কবি জীবনানন্দ দাশ। প্রাণ প্রোথিত করেছেন প্রাণের ভিতর।
চলমান জীবন ও অতীতের গভীর সংযোগ আর হেঁটে যাওয়া অসাড় আগামী দ্যুতিময় বাক্যবিন্যাসে আধুনিক কবিতার রুঢ় হাত থেকে সম্ভাবনাময় উত্তর আধুনিকতার নির্যাস তাঁর কবিতা। প্রকৃতির ভেতরে প্রকৃতি, জীবনের ভেতরে জীবন উপলব্ধি ও বিন্যাস তাঁর কবিতার গঠনকে করেছে সংহত ও অপরূপ ব্যাঞ্জনাময়, উপলব্ধির গভীর বুনন মননকে বিন্যস্ত করে, সুবিন্যস্ত করে পঠন। তার কবিতা পাঠে জীবনের অতল স্পর্শ করে মন। সে অতলে ডুবে প্রাণরস আহরণ করে হয় অমৃতপূর্ণ। রুপসীবাংলার রূপসৌন্দর্য্যে স্বার্থক কবি। ধানক্ষেত, জলাঙ্গীর ঢেউ ভেজা করুণ ডাঙা আর চালতা ফুলের নিবিড়তা। বনলতাসেনের আবহমান প্রেম জীববৈচিত্র্যের সন্ধান দেন। ইতিহাস ও ঐতিহ্য উদঘাটনের পাশাপাশি বিশ্ববৈচিত্র ধরা দেয় কুশলতায়। জীবনের অন্ধকার ঘেঁটে ঘেঁটে দেখেছেন জীবন হননকারী বেদনার খুঁটিতে ঝুলেথাকা লাশে। আজীবন বেদনায় ক্লান্ত ও রুগ্ন কবিমন তাই তো প্রকৃতি ও প্রেমে শুদ্ধ হয়ে উঠে। বাক্যের অলঙ্কারে দ্যুতি ছড়িয়ে বাগ্ময় চিত্রধারা বিচ্ছুরিত করেন। তিনি প্রেমের কবি, ধ্যানের কবি, মগ্ন সৌন্দর্যের কবি, মুগ্ধতার কবি, শুদ্ধতার কবি । এককথায় তিনি কবিদের কবি।
মানুষের জীবন ক্ষুদ্র। মানবসমষ্টির জীবন ক্ষুদ্র নয়। একজন টেনে নেয় আরেকজনের জীবন। এক সভ্যতা আরেক সভ্যতাকে। এক আবিষ্কার অন্য আবিষ্কারকে। এই সুতোর মতো সম্পর্ক তা এক ও অভিন্ন। যুগে যুগে কালে কালে মানুষ রেখে যায় পদচিহ্ন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
এখানেই ফিরে আসে হিজল তলায়
ছাতিমের ডালে পেঁচা আগামীর সতর্কতা নিয়ে
বনলতা সেন চিরঅপেক্ষার সান্নিধ্যে হাজার বছর ধরে