এম এ মজিদ, হবিগঞ্জঃ “আমরা স্বামী স্ত্রী এবং দেড় বছরের কন্যা সন্তান সবাই করোনা আক্রান্ত। এর মধ্যে আমার অবস্থা অবনতি হয় বেশি। শ্বাসকষ্ট, একই সাথে প্রচন্ড জ্বর, সারা শরীরে ব্যথা। স্ত্রীর অবস্থাও ভাল না, জ্বর ও ব্যথায় উঠে দাড়ানোর অবস্থায় ছিল না। এরই মধ্যে আক্রান্ত হয় ১ বছর ৪ মাসের কন্যা সন্তান। নাক দিয়ে পানি পড়া, স্বাভাবিক শ্বাস নিতে না পারা, জ্বর, ব্যথা। মেয়েটা ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। একটা পর্যায়ে মনে হল, আমাদের পৃথিবী শেষ পর্যায়ে। চিন্তা করলাম, শেষ যুদ্ধটা করবই। অন্তত আমাদের যা হবার হবে, সন্তানটাকে বাচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। ঠিক এই চিন্তা যখন আমাদের মাথায় আসল, নিজেদের কষ্টটা ভুলতে লাগলাম”। কথা বলছিলাম, এনজিও আশা’র লোন অফিসার হবিগঞ্জের যুবক ইমতিয়াজ উদ্দিন ইমন, তার স্ত্রী পুলিশের এসবি শাখায় কর্মরত নারী পুলিশ সদস্য ও তাদের একমাত্র কন্যা সন্তানের কথা। করোনার সাথে যুদ্ধ করে এখন তারা তিনজনই সুস্থ। তবে সুস্থ হওয়ার পরও সমাজের কিছু মানুষের কারণে তারা মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠেনি। কিছু মানুষ মনে করে করোনা রোগী মানেই পঁচে গেছে, তাদের ধারে কাছে যাওয়া যাবে না।
১৬ মে প্রথমে ইমতিয়াজ উদ্দিন ইমন জ্বর ও ব্যথায় আক্রান্ত হন। ডাক্তার প্রদীপ দাসকে ফোন করে কিছু ঔষধ লিখে নেন। জ্বর হওয়ার পর নিজে থেকেই আইসোলেশনে চলে যান ইমন। কিন্তু স্ত্রী কোনভাবেই মানছিলেন না। যা হবার হবে, স্বামীর যতœ করতেই হবে। আক্রান্ত স্বামীর সেবা করতে থাকেন পুলিশ সদস্য স্ত্রী। দুই দিনের মাথায় আক্রান্ত হন স্ত্রী এবং ১ বছর ৪ মাসের একমাত্র সন্তান। তিনজনেরই একই উপসর্গ। বুঝতে বাকী নেই সবাই করোনা আক্রান্ত। ২০মে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করা হয় তিনজনের। ২২মে তিনজনেরই রিপোর্ট আসে করোনা পজিটিভ। প্রথমে ভেঙ্গে পড়েন তারা। মৃত্যুর হাতছানি যেন চারদিক থেকেই তাদেরকে ডাকছে। মেয়ের শ্বাস কষ্ট দেখে নিজেদের শ্বাস কষ্টের কথা ভুলে যান ওই দম্পতি। ডাক্তারদের দেয়া ঔষধ সেবনের পাশাপাশি গরম পানি পান, গরম পানির ভাপ নেয়া ও গরম পানির গারগল করা নিত্যসঙ্গী করা হয়। কিন্তু ১ বছর ৪ মাস বয়সী বাচ্চার দ্বারা কিভাবে এসব সম্ভব? মেয়ের চোখের পানির সাথে মা বাবার চোখের পানি একাকার হয়ে যায়। বিভিন্ন কৌশলে ছোট্ট শিশুটিকে উপরুক্ত থেরাপী দেয়া অব্যাহত রাখেন ওই দম্পতি। অবস্থার অবনতি হতে থাকলে স্ত্রী ও কন্যাকে হাসপাতালে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেও প্রায় একই চিকিৎসা। এরই মধ্যে ইমনের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে নিজেও ভর্তি হন একই হাসপাতালে। এবার হাসপাতালে চলে তাদের প্রায় একই ধরনের যুদ্ধ। আস্তে আস্তে সুস্থ হতে থাকেন তারা। ৩ জুন আবার তারা নমুনা পরীক্ষা করান। ৪ জুন আসে করোনা নেগেটিভ। ইমতিয়াজ উদ্দিন ইমন মনে করেন-শক্ত মনোবল ও হেরে না যাওয়ার প্রত্যয় থাকতে হবে। পরিবারের শিশুরা আক্রান্ত হলে তাদেরকে এক মিনিটের জন্য ছেড়ে যাবেন না। পাশাপাশি কিছু ঔষধ আর গরম পানি থেরাপী অব্যাহত রাখলে করোনা আক্রান্ত হলেও তা থেকে সেড়ে উঠা সম্ভব। কিন্তু সুস্থ হলে আপনাকে আরেকটা যুদ্ধে নামতে হবে। সেটা হল মানসিক অবহেলা আর অবজ্ঞার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সেটা করা লাগে সমাজের গুজব ছড়ানো কিছু লোকের বিরুদ্ধে। অথচ করোনা আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি সুস্থ হয়ে করোনা নেগেটিভ হলে তার প্লাজমা দ্বারা অন্য করোনা রোগী সুস্থ হতে পারে। দ্বিতীয়বার কেউ করোনা আক্রান্ত হলেও করোনা ভাইরাসটি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে তার মধ্যে প্রবেশ করে। ইমতিয়াজ উদ্দিন ইমন বলেন- করোনা আক্রান্ত হয়ে ডাক্তার নার্স, আমার ও আমার স্ত্রীর পরিবারের লোকজন, আত্বীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, অফিসের সহকর্মী, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সবাই যেভাবে সাহস যুগিয়েছেন, তা বিরল। কিছু মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টালে করোনা কষ্টসাধ্য হলেও জয় করা সম্ভব।
লেখকঃ আইনজীবী ও সংবাদকর্মী