[ এক ]
ছাদের উপর দাঁড়িয়ে ব্রাশ করতে করতে দ্বিতীয় বিয়ের পরিকল্পনা করছিলাম আমি। হঠাৎ আমার স্ত্রী পিছনে এসে সালাম দিলো-
— আসসালামু আলাইকুম। জনাব!
চমকে উঠলাম আমি। ও যে কখন এসে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি!
— ওয়ালাইকুমুস সালাম। রাণী সাহেবা!
— একা একাই আকাশ দেখছেন?
— জ্বি একাই দেখছি। আপনি তো রুমে বসে বসে চোখে কাজল দিচ্ছিলেন! তাই ভাবলাম একটু ছাদ থেকে হাওয়া খেয়ে আসি। কি চমৎকার রোদ উঠেছে আজ!
— হুম ভীষণ সুন্দর। দেখতে হবে না কে বানিয়েছে!
— সুবহানাল্লাহ।
— এখন বলো! কি যেনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চেয়েছিলে!
— এখুনি বলবো? এখন ব্রাশ করছি তো!
— উঁহু। এখুনি বলো তো। আরেকটু দেরি করলেই ব্লাড প্রেশার হাই হয়ে যাবে আমার। আমি আবার বেশি উত্তেজনা সহ্য করতে পারি না।
— অস্থিরতার কিছু নেই জনাবা। এটা তোমার জন্য একটা সুখবর! বলতে পারো সারপ্রাইজ।
— সত্যি? ইশ!… দ্রুত বলে ফেলো তাহলে!
— আচ্ছা বসো আগে, এরপর বলছি!
রুবাইয়ার হাত ধরে ফ্লোরে বসালাম আমি। কথাটা শোনার জন্য কাল থেকেই অস্থির হয়ে আছে সে। চোখে মুখে ভীষণ উদ্বিগ্নতা লক্ষ করলাম। কি হতে পারে সারপ্রাইজ, এটা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছে বেচারি। অবশেষে কথাটা বলেই ফেললাম —
— তোমার জন্য একটা সখি আনবো বলে সিন্ধান্ত নিয়েছি। তুমি কি বলো?
— সখি! সেটা আবার কি? কোনো খাওয়ার জিনিস নাকি? মনে পরেছে, Shokhi ice Cream নামে একটা ব্রান্ড দেখেছিলাম মাসখানেক আগে! তুমি নিয়ে এসেছিলে। খেতে ভীষণ মজা লেগেছিল। কিন্তু এখন তো ভরা শীত, এ সময় কি আর আইসক্রিম…
— উঁহু থামো তো! তোমার ভেতর কি খাওয়া ছাড়া আর কোনো কথা নেই? অন্য কিছু ভাবতে পারো না?
— অন্য কিছু কি হতে পারে!
— এখানে সখি বলতে আমি তোমার একজন বান্ধবীর কথা বুঝিয়েছি, যে তোমার দৈনন্দিন কাজগুলোতে হেল্প করবে, জামা-কাপড় ধুয়ে দিবে, ঘর ঝাড়ু দিবে, বাসন মাজবে, আমি যখন বাইরে থাকবো তোমার সাথে গল্পগুজব করবে।
— আমি এখনো বুঝতে পারছি না কোন বান্ধবীর কথা বলছো তুমি!
— মানে আমি দ্বিতীয়’র কথা বলছি!
— দ্বিতীয় মানে?
— থাকেনা! ঐ…
রুবাইয়ার হাসি হাসি মুখখানা মুহুর্তের মলিন হয়ে গেলো। ভয় পাওয়া গলায় বললো-
— তুমি কি আরেকটা বিয়ে করতে চাচ্ছো নাকি?
— হ্যাঁ। এইতো ধরতে পেরেছো। এই না হলে আমার বউ! একেবারে ঝকঝকে নিউরনের সার্ফ মস্তিষ্কের মেয়ে!
কথাটা বলেই রুবাইয়ার গাল টেনে দিলাম আমি। হাসানোর চেষ্টাও করলাম। কিন্তু একটুও হাসলো না সে। বরং চোখে পানি আসি আসি ভাব নিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো-
— কিন্তু কেনো আরিফ? হঠাৎ কি হলো তোমার যে বিয়ে করতে চাও?
— অনেক ভেবে দেখলাম বুঝলে! আমার একজন হার্ড সঙ্গিনী দরকার। যে তোমার মতো এতো আবেগপ্রবণ হবে না। অলস হবে না। কঠোর পরিশ্রমী হবে। প্রতিদিন তোমার মতো মুরগী আর কবুতর খেয়ে বারোটা বাজাবে না। প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিসের বায়নাও ধরবে না। আর তোমার মতো এতো সুন্দরীও হবে না। গায়ের রঙ হবে শ্যামলা। তবে দাঁত থাকা চাই ঝকঝকে পরিপাটি। নাকটা হবে একটু লম্বা সাইজের তোমার মতো থ্যাবড়া নেকো না। আর রোমান্টিকতার দিক দিয়েও সে হবে…
রুবাইয়া আর কিছুতেই চোখে পানি ধরে রাখতে পারছে না। আমি এক নিঃশ্বাসে আমার দ্বিতীয় বউয়ের সমগ্র পরিচয় তুলে ধরে হাসি-হাসি মুখ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
রুবাইয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বললো-
— এই তোমার সারপ্রাইজ?
— হ্যাঁ। কিন্তু তুমি এতো কষ্ট পাচ্ছো কেনো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তোমার কতো কাজে হেল্প করবে সে সেটা তো একবার ভাবো! এইযে মাঝে মাঝে কাপড় কাচতে গিয়ে তোমার যে কোমর লেগে যায়। প্রায়ই আমার কাছে এসে বারবার বলো- এতো কাজ আমি করতে পারবো না। এরপর কখনো বলো ওমুক কাজটি করতে পারবো না, তমুক কাজ করতে গেলে হাড় গুঁড়ো হয়ে যাবে। তাই অনেক ভেবে চিন্তে আমি এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছি। এখন থেকে তোমার দুঃখের দিন শেষ রুবাইয়া!
রুবাইয়া আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো-
— তুমি কি সত্যিই সিরিয়াস আরিফ?
— আরে সিরিয়াস না মানে! অলরেডি আমি ঘটকের সাথে কথাও বলে এসেছি। মেয়েও রাজি হয়ে গেছে। এখন শুধু বিয়ে করে নিয়ে আসা বাকি। আহহ..। কি যে আনন্দ লাগছে আমার! ইচ্ছে করছে কোমর দুলিয়ে মধু পুষ্প কাননের প্রজাপতিদের মতো নাচি!
রুবাইয়া আর সামলাতে পারলো না। কেঁদেকেটে নাকের পানি চোখের পানি একাকার করে দিলো!
আমি হাসি-হাসি মুখ নিয়ে তার অপরূপ চোখ দু’টোর দিকে তাকিয়ে আছি। চোখের পানির সাথে কালো কাজলের মিশ্রণ ঘটিয়ে নরম গালের উপর দিয়ে বেয়ে যাচ্ছে। মিষ্টি রোদে আলোর ঝলকানিতে চোখের পানি যেনো কাজল মিশ্রিত মুক্তা মনে হলো আমার কাছে। কি অপূর্ব এক দৃশ্য!
রুবাইয়া নাক মুছে বললো-
— আমার চোখের পানিরও কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?
আমি মৃদু হেসে বললাম-
— এই যে তুমি এতো আবেগপ্রবণ, অল্পতেই কেঁদে ফেলো, কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারো না। এই ব্যাপারটা নিয়েই অনন্ত একটিবার চিন্তা করে দেখো!
— কি চিন্তা করবো?
— এই যে এখন যেমন কাঁদছো। ঠিক এই সময় যদি তোমার পাশে তোমার একজন সখি মানে তোমার সতিন থাকতো, তাহলে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো..! কি করে হার্ড হয়ে থাকতে হয় বোঝাতো..! কি করে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেটাও বোঝাতো..! ধীরে ধীরে তুমিও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে পারতে। এটা তোমার জীবনে কতোবড় একটা প্রাপ্তি হতে চলেছে তুমি কি বুঝতে পারছো রুবী?
— আমার আর কিচ্ছু বুঝাতে হবে না আরিফ। করো তুমি বিয়ে। একটা না আরও দশটা করো। আমি তোমায় একটুও বাঁধা দিবো না।
কথাগুলো বলেই হিজাবে চোখ মুছলো রুবাইয়া।
— উঁহু। বিয়ে তো দশটা করা সম্ভব না। আরও ৩ টা করতে পারবো। অবশ্য তখন আরো ভালো হবে! চারজনে বসে আমরা দিব্যি লুডু খেলতে পারবো! কি বলো?
রুবাইয়া এবার উঠে দাঁড়ালো। উঠেই কোনদিকে না তাকিয়ে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেলো। আমি জানি, ও এখন কবিতার খাতা নিয়ে বসবে। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আমায় নিয়ে কবিতা লিখবে!
এক ঝুড়ি অভিযোগ নিয়ে ভরিয়ে ফেলবে ডায়েরির পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা!
[ দুই ]
রুমে এসে দেখি রুবাইয়া বালিশে মুখ লাগিয়ে কাঁদছে।
পাশেই ওর ডায়েরিটা পরে আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে ডায়েরিটা হাতে নিলাম। কিন্তু ও কিছুই লিখতে পারেনি ডাইরিতে! কবিতার একটা লাইনও নয়! সম্ভবত অধিক আবেগ নিয়ে কান্না করতে গিয়ে আর কবিতা লেখা যায় না। কবিতার লাইনগুলোও তখন কবির সাথে কাঁদতে থাকে!
আচ্ছা, এভাবে কাঁদার কি কোনো মানে হয়? শুধু বলেছি দ্বিতীয় বিয়ে করবো তাতেই এই অবস্থা। এখনো তো বউ ঘরেই নিয়ে আসি নি! আসলে যে কি অবস্থা হতো!
— এই রুবাইয়া!
রুবাইয়া ছোট বাচ্চাদের মতো ফোঁপাচ্ছে। আমি ওকে উঠে বসালাম। কেঁদেকেটে চোখ দু’টো ফুলিয়ে ফেলেছে একদম।
— ধুর পাগলী এভাবে কাঁদছো কেনো! আমি কি বিয়ে করে ফেলেছি নাকি? বিয়ে করবো কিনা তোমার কাছে সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছি মাত্র। তাতেই এই অবস্থা! আচ্ছা যাও বিয়ে ক্যান্সেল! যতদিন বেঁচে আছি, বিয়ের নাম মুখেও নিবো না।
রুবাইয়া আমায় জড়িয়ে ধরে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগলো। কি আর করার। ওর কান্না দেখে আমিও আর কান্না আটকাতে পারলাম না। কেমন যেনো একটা অদ্ভুত রকমের টান অনুভব করলাম ওর জন্য! আচ্ছা, এটাকেই কি ভালোবাসা বলে?
রুবাইয়া ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললো-
— তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসবে এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না আরিফ। কোনোদিনও পারবো না।
আমি চোখ মুছে বললাম-
— আমি সেটা জানি রুবাইয়া। আসলে আমি বিয়ে করার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলিনি তোমায়। অন্য একটা কারণে বলেছি।
— কিন্তু, কি কারণে?
— দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে তোমার অবস্থাটা কেমন হয় সেটা জানার জন্যই অনেকটা অভিনয় করেছি আমি।
— অভিনয় করেছো?
— হ্যাঁ। আচ্ছা, তোমার থেকে আর কে বেশি সুন্দরী আছে বলো তো? আমার চোখে তুমি পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী মেয়ে। আর তোমাকে থ্যাবড়া নেকো বলেছি, চার জনে লুডু খেলতে চেয়েছি, বিয়ে ঠিকঠাক কিনা ইত্যাদি বলেছি তোমার অবস্থাটা বোঝার জন্য।
কোথাও কি শুনেছো, মানুষ লুডু খেলার জন্য বিয়ে করে? উপরন্তু এটা তো হারাম একটা খেলা!
— কিন্তু কেনো এমন অভিনয় করলে? কি প্রয়োজন ছিলো এসবের?
— একটা সুক্ষ্ম বিষয় অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন ছিলো।
— কি সেটা?
— বলছি আমি। এখন আমার সামনে চুপটি করে বসো তো। আর হ্যাঁ, একটুও কাঁদবে না কিন্তু। একদিনে অনেক কেঁদেছো তুমি।
রুবাইয়া আমায় ছেড়ে দিয়ে বসলো। আমি ওর চোখ মুছে দিলাম। কিন্তু যত বারই মুছে দেই ততই অধিক হারে আবার নতুন করে জল গড়ায়! এই মেয়ে এতো কাঁদে কেনো বুঝিনা আমি। ওর কান্না দেখে আমিও আর ঠিক থাকতে পারি না। কাউকে যে এতোটা ভালোবাসতে হয়না, এটা কে ওকে বোঝাবে? এতোখানি ভালোবাসার মূল্য দেওয়ার মতো সাধ্য কি আমার কাছে আছে?
— উঁহু। আর কেঁদো না তো প্লিজ। এই দেখো কান ধরছি আর কখনোই দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলবো না।
আমি সত্যি সত্যি কান ধরলাম। উঠবস করারও প্রস্তুতি নিলাম। সেই ছোটবেলার অভ্যাস। মায়ের সামনে কতো যে কান ধরে উঠবস করেছি! দশবারো বার উঠবস না করলে আম্মা আমাকে ছাড়তোই না। কিন্তু রুবাইয়ার সামনে মাত্র একবার উঠসব করতেই আমার হাত ধরে ফেললো।
— তোমায় কান ধরতে হবে না প্লিজ। বরং আমার হাতটা একটু শক্ত করে ধরে থাকো।
আমি রুবাইয়ার হাত ধরলাম। ওর হাতদুটো কাঁপছিলো।
— কতোটা কষ্ট পেয়েছি জানো?
— এতোটা কষ্ট যে পাবে আমি ভাবতেও পারিনি রুবী। আমায় ক্ষমা করে দাও। নতুবা কোনো শাস্তি দাও।
— তোমায় ক্ষমাও চাইতে হবে না। শাস্তিও পেতে হবে না। কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু একটু ভালোবাসলেই চলবে। ছোট্ট একটা ইলেকট্রন পরিমাণ ভালোবাসতে পারবে আমায়? তাও যদি না পারো, অন্তত একটা হাইড্রোজেন পরমাণু পরিমাণ! সেটাও সম্ভব না হলে অন্তত আলোর এক ফোটন বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা দিও! তবুও শূন্যতার তীব্র মিছিল আমি সহ্য করতে পারবো না আরিফ!
কথাগুলো বলে আবার ফুঁপিয়ে উঠলো রুবাইয়া। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম-
— এমন করে আর বলিও না প্লিজ। কষ্ট পাচ্ছি। আমি তো তোমাকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসতে রুবাইয়া।
তুমি হয়তো ভাবছো তোমাকে আমি তেমন ভালোবাসি না বলে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলেছি! তাহলে ভুল ভাবছো তুমি। আমি কেনো এসব বলেছি এর মূল কারণটা শুনো এখন।
তোমায় বিয়ের কথা বলে আমি একটা সুক্ষ্ম বিষয় বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম অংশীদারত্বের কষ্টটা আসলে কেমন হতে পারে! এবং জানার পর ভীষণ বিস্মিত হয়ে গেছি।
আমি বুঝতে পেরেছি একজন সামান্য মানুষও তার ভালোবাসার ভাগটুকু অন্য কাউকেই দিতে চায় না। দুইটি নয়, তিনটি নয় একটিমাত্র ভাগীদার থাকুক সেটাও সে সহ্য করতে পারে না! সল্প সময়ের জন্যও একটিমাত্র অংশীদার থাকুক, সেটাও সে মেনে নিতে পারে না!
বিষয়টা এখানেই রুবাইয়া, দেখো তুমি একজন ছোট্ট সৃষ্টি হয়ে যদি কোনো অংশীদার মেনে নিতে না পারো! তাহলে আল্লাহ পাক কিভাবে মেনে নেন? তিনি কতোটা কষ্ট পান? তিনি কতোটা সহ্য করেন আমাদের?
এই যে আমরা এতো শীরক করছি, তাঁর স্থানে আরেকজনকে এনে বসাচ্ছি, তাঁর সাথে অন্য কারও ইবাদত করছি। জবান দিয়ে, হৃদয় দিয়ে, কর্মকলাপ দিয়ে তাঁর পাশাপাশি আরেকজনকে মাবুদ হিসেবে শরিক করে নিচ্ছি, এটাতে স্বয়ং আল্লাহ পাকের তাহলে কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়!
চাকরিকে মাবুদ মানছি— “ওমুক চাকরিটা না হলে এতোদিনে মরে যেতাম!”
ব্যাবসাকে মাবুদ মানছি— “ওমুক ব্যাবসাটা না হলে আমি না খেয়ে মরতাম!”
পীর সাহেবকে মাবুদ মানছি— “ওমুক পীরে কেবলা না থাকলে কি যে হতো! আমি আর মা হতে পারতাম না!”
ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি…
তার মানে আল্লাহ পাক রিজিক দিতে গিয়ে, সম্পদ দিতে গিয়ে, বাচ্চা দিতে গিয়ে এসবের মুখাপেক্ষী? যদি তা না হয়েই থাকে, তাহলে কেনো আমরা আল্লাহর আসনে এগুলোকে বসাচ্ছি? কেনো তাঁর ভালোবাসায় অন্য কাউকে টেনে আনছি?
কেনো তাঁর কৃত্বিতে অন্য কাউকে কৃতিত্ববান মনে করছি?
কেনো তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্যে অন্য কাউকে ক্ষমতাধর মনে করছি?
তুমি যদি আল্লাহর একজন সামান্য সৃষ্টি হয়েও তোমার একজন অংশীদার থাকুক এটা মেনে নিতে না পারো, তাহলে আল্লাহ পাক কিভাবে মেনে নিবেন রুবাইয়া?
কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম আমি। রুবাইয়া থ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার আর কান্না কিছুতেই থামছে না। আহহ.. এতদিন সেই মালিকের কতোই না শীরক করেছি! কতোই না অসন্তুষ্ট করেছি! তাঁর খেয়ে, তাঁর দেওয়া জীবন নিয়ে, তাঁর দেওয়া শরীর নিয়ে অকপটে অন্য কোনো সত্তাকে তাঁর সমকক্ষ মনে করেছি! এটা কতো চরম অন্যায়, কতো চরম ঘৃণিত কাজ!
রুবাইয়া আমার চোখ মুছে দিতে দিতে বললো-
— তুমি ঠিক বলেছো আরিফ। এটা আসলেই ভীষণ যন্ত্রণার। নিজের ক্ষমতায় কাউকে ভাগ দেওয়া কিংবা কাউকে অংশীদার বানানো এটা সহ্য করা কঠিন। আমি সেটা হারে হারে টের পাচ্ছি! আর কখনোই আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবো না।
জীবন গেলেও না!
তিনি একাই এই রাজত্বের মালিক।
তিনি ছাড়া সবকিছুই তাঁর অধীন, তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিস তাঁর হুকুম মেনে চলে। তিনি কারো হুকুম মানেন না। সবকিছুতেই তাঁর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বিরাজ করছে।
জগতকে তিনি কতো চমৎকার সিস্টেমেই না নিয়ন্ত্রণ করছেন! চাকরি, ব্যাবসা, বাণিজ্য, খাদ্যশস্য, পশুপাখি, পাহাড় নদী, যা কিছুই আছে এসব তাঁরই পরিকল্পনার অংশ। এগুলো মাবুদ নয়। এগুলোর কোনো শক্তি নেই। এগুলো ছাড়াও তিনি খাওয়াতে পারেন। চলাতে পারেন। এসব দিয়েছেন তো শুধু সিস্টেম রক্ষার খাতিরে। মূল কতৃত্ব তো তাঁর হাতেই। এসব কেবলই মাধ্যম মাত্র!
আমি চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম-
— যাও ওযু করে আসো। মহান প্রতিপালকের সামনে মাথা নত করে আজ আমরা একটা জিনিসই চাইবো।“ যতদিন বেঁচে আছি, আর যেনো কখনোই শীরক না করি!”
— আচ্ছা।
রুবাইয়া ওযু করতে গেলো। আমি ওর ডায়েরিটা খুললাম। হঠাৎ দেখি, ভাঁজ করা পৃষ্ঠায় কি একটা কবিতা লিখেছে আমার বউ! পড়তে পড়তে না হেসে পারলাম না। আচ্ছা, পাগলীটা এতো ভালোবাসে কেনো আমাকে?