এই বৈশাখে চারদিক আলোকিত করে যখন সূর্য ওঠে, রোদ বাড়ে, বোরো ধান তোলা কৃষকের আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকে না আর। প্রখর রোদে পুড়ে পুড়ে চেহারা তাদের কালচে-তামাটে হয় বটে, ভেতরটা আনন্দে খাঁটি হীরার মতো চকচক করতে থাকে তখন। উতলে উঠা খুশির জোয়ারের অবিরাম ধারায় বইতে থাকে হৃদয়ে তাদের। এই আনন্দে ৪০-৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও একটানা কাজ করে যায় অনায়াসেই কোনো অভিযোগ ছাড়া।
কালবৈশাখীর আনাগোনায় আকাশ যদি হঠাৎ মেঘে মেঘে ছেয়ে যায়, হৃদয় তাদের অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠে। কারণ এই বৈশাখে সপ্তাহখানেকের ঝড়-বাদল কিংবা অযাচিত পানি/বন্যা পুরো বছরের দুর্ভোগের কারণ হতে পারে তার এবং তার পরিবারের জন্য। কারো কারো পুরো জীবনের দুর্ভোগও ডেকে আনতে পারে এই বৈশাখের রোদহীন বাদলা কয়েকটি মাত্র দিনেই। অতিবৃষ্টি আর রোদহীন কিছু বৈশাখ ঋণে জর্জরিত কত প্রান্তিক কৃষককে যে ভিটেমাটি ছাড়া করেছে হাওরের গ্রামগুলোতে খোঁজার অভ্যাস না থাকলে কখনো বুঝতে পারবেনা কেউ।
বোরো কৃষকের জীবন জীবিকা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা যাদের নেই, তারা এর মানে বুঝবেনা কিছুতেই। এসির নিচে বসে ননির পুতুলদের কেউ একথার মানে বুঝবে আশা করার প্রশ্নই আসে না কোনো। যদি বুঝতো, হাওরাঞ্চলের কৃষকের পরিবারসহ গৃহপালিত পশুর পুরো বছরের খাদ্য নিরাপত্তা এবং সার্বিক ব্যয় নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম এই ধান সংগ্রহের মৌসুমে রোদ/গরম নিয়ে কেউ হাহুতাশ আর ছ্যাবলামি করতে যেতো না কোনোভাবেই। কেবল নিজের আরামের জন্য হাজার হাজার কৃষক পরিবারকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নিক্ষেপের জন্য সালাতুল ইস্তেস্কা পড়ে বৃষ্টির দোয়া করা তো অনেক দুরের কথা ছিল তখন।
হাওরাঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকরা আমাদের মতোই মানুষ। এসি-ফ্যানহীন ঘরে এই গরমের কষ্ট তারাও ভোগ করে এখন। ঘুমহীন রাতে হাঁসফাঁস করে জান যায় যায় অবস্থা তাদেরও হয়। তবুও কায়মনোবাক্যে দোয়া করে, সকাল থেকেই যেন মেঘহীন কাঠফাঁটা রোদ থাকে সারাটা দিন। যাতে ধান-খর সংগ্রহে ব্যাঘাত না ঘটে কিছুতেই।
আমাদের দোয়া কেবল নিজেদের আরামে ব্যাঘাত ঘটার কারণে, তাইতো? কৃষকের দোয়া আমাদের চাইতে আরো আরো ব্যাপক। তার নিজের, তার পরিবারের, তার গৃহপালিত পশুর এমনকি আপনার খাদ্যও সঠিকভাবে সংগ্রহের জন্য।
হাওরাঞ্চলে জন্ম, বেড়ে উঠা এবং খুব কাছ থেকে কৃষকের অবস্থা দেখার কারণে আমাদের কিছু কিছু দোয়া কেনো কবুল হয় না এখনকার মতো এতো গভীরভাবে বুঝতামনা বোধহয় কিছুতেই।
বিভিন্ন উৎসব নিয়ে যারা খুব মাতামাতি করেন, আমাদের হাওরাঞ্চলের এই বৈশাখী ধানকাটা উৎসবটা একবার দেখে যান। যত গোমড়া মুখোই হন, রোদে-পোড়া-কালচে-তামাটে চেহারার মানুষগুলোর আনন্দ আপনাকে ছুঁয়ে যাবেই যাবে। এই রোদ, এই গরম আপনার কাছে খুব তুচ্ছই মনে হবে তখন।
শীতকালে অতিথি পাখির আধিক্যের নিউজের সুবাদে হাকালুকি, টাঙ্গুয়া, হাইল হাওরের নাম জানেন অনেকেই। মিঠামইন- অষ্টগ্রামে আধুনিক রাস্তার কারণে সেখানকার হাওরগুলোও দেখেছেন কেউ কেউ। বাংলামি নাকি পাকনামি নামক ১৪কিমি. আলপনা এঁকেছে যে হাওরের রাস্তায় সেটার কথা বলছি।
নিকলী, ইটনা, নলুয়া, পচাশোল, মইয়া, মকা, রায়েরগাঁও, সুরমা, সুমাই, শাল্লা, হুমাইপুর, আপনা, বাগহাতা, গুঙ্গিয়াজুরী, বুল্লা, শনির হাওরসহ সিলেট, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের শতশত হাওরের নাম জীবনেও হয়তো শুনেননি অনেকে।
বছরের প্রায় অর্ধেক সময় পানির নিচে থাকে এসব হাওর। বর্ষার থৈথৈ পানি এমন পর্যায়ে হয়, যেন পৃথিবীর ৬ষ্ঠ মহসমুদ্র এখানেই আছে। দূর থেকে দেখলে হাওরের মাঝের গ্রামগুলোকে পানিতে ভাসা ছোট্ট নৌকা কিংবা কচুরিপানার দলা মনে হয় তখন। পানির সাথে হাওরবাসী মানুষের বংশপরম্পরায় রয়েছে আজন্ম মিতালি। এই মানুষগুলোই বৈশাখে কোনোভাবেই পানি চায় না; বৃষ্টি চায় না। সবসময় তো আর চাওয়া অনুযায়ী সবকিছু হয় না। বৃষ্টিও হয়, পানিও আসে। অসময়ে তলিয়ে যায় সোনালী ফসল। এই বৈশাখের অকাল বৃষ্টি কত কত বার যে হাওরবাসীর স্বপ্ন ভালবাসার সলিল সমাধি দিয়েছে ইয়াত্তা নেই তার। বৈশাখের বৃষ্টিকে অকাল বলাতে খটকা লাগতে পারে কারো। পুড়খাওয়া কোনো প্রান্তিক কৃষককে জিজ্ঞেস করে দেখুন, সত্যিটা কি।
এসব হাওরে পুরো বছরে একটিইমাত্র ফসল। সেটা হচ্ছে বোরো ধান। কৃষক পরিবারের পুরো বছরের আনন্দ-উৎসব, বিয়েশাদীসহ সকল অনুষ্ঠানের খরচপাতি আর খাদ্যের নির্ভরতা এই ফসলের উপরই। বোরো ধান তোলায় কোন ব্যাঘাত ঘটলে পুরো বছরের হিসাব নিকাশে ব্যাঘাত ঘটে তাদের। এই সোনালী ফসল কখন ঘরে উঠে, কেউ জানেন কিছু? গ্রীষ্মের প্রথম অংশ পুরো বৈশাখ জুড়ে। তাই, হাওরবাসীর একটাই চাওয়া, বৈশাখটা হোক মেঘবৃষ্টিহীন কড়কড়ে শুকনো; শুষ্ক বৈশাখ। এই বৈশাখে আরামের জন্য ২/৪ দিনের বৃষ্টিও তারা চায় না কভু। কারণ দুয়েকদিনের বৃষ্টিতেই হাওরের নিচু জমির অন্তত ১০% ক্ষেত তলিয়ে যাবে; তলিয়ে যায়ও। বৃষ্টি ৫/৭ দিন হলে ক্ষতির পরিমাণ তখন দ্বিগুণ হবে। হাজার হাজার টন ধানের মাঝে ১০% মানে কত মণ হয়, বুঝেন কিছু?
হাওরের প্রায় সব কৃষকই শ্রমিক সংকটে ভোগে। বৃষ্টি যদি হয়, পানি যদি বাড়ে, কাজ বেড়ে যায়, শ্রমিক সংকট তখন আরো তীব্র হয়। কেটে ফেলা ধান শুকাতে যদি দু’চার দিনের বেশি সময় লাগে, আর ধান যদি হয় বৃষ্টিভেজা, ধানের রং পরিবর্তন হয়ে বাজারে এর মূল্য যায় কমে। পানিতে ভেজা পশুখাদ্য খরগুলো মাড়াইয়ের পর সাথে সাথে শুকানো না গেলে এর টেম্পার কমে নষ্ট হয়ে যায়।, পশুও তখন এসব খর খেতে চায় না আর। অথৈ বর্ষায় নিজের খাদ্যের সাথে পশুখাদ্য নিয়েও ঝামেলায় পড়ে কৃষক পরিবার। সবার পরিস্থিতি এক হওয়াতে কিনতে চাইলেও খরের দাম হয় আকাশচুম্বী।
বৈশাখে সপ্তাহখানেক বৃষ্টি হলে ধান কাটা, মাড়াই করা, খর শুকানো, ধান পরিবহনসহ সকল কাজে শ্রমিক সংখ্যা, পরিবহন খরচ, শ্রমিক খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। একদিকে খরচ যোগাতে গোলায় তোলার আগেই বাধ্য হয়ে বেশি ধান করতে হয় বিক্রি। অপরদিকে খরের অভাবে গৃহপালিত পশুগুলোও করতে পারেনা লালনপালন। বিক্রেতা বেড়ে যাওয়ায় তখন ধানের মতো পশুর দামও যায় অনেক কমে। লসের উপর লস দিয়ে পরবর্তী বছরের ধান তোলার আগেই অর্থাৎ ফাল্গুন-চৈত্র মাসে কৃষক পরিবারে দেখা দেয় খাদ্যের অভাব। বাধ্য হয়ে তখন, হয় ঋণ করে কৃষক; নয়তো জমি বন্ধক দেয়; জমি বেচে। পরপর দুয়েক বছর এমন হলেই কৃষক আর ঋণের বোঝাও টানতে অক্ষম হয়ে পড়ে। বাধ্য হয় কৃষক পরিবার নিয়ে ভিটেমাটি ছাড়ে। প্রান্তিক কৃষকের ২০/৩০ হাজার টাকা ঋণের মানে কতবড় বোঝা সেটা হয়তো ধারণাও করতে পারবেন না কেউ। ইংগিত দিয়ে রাখি, ব্র্যাক, আশা, ব্যুরো, সীমান্তিকের মতো এনজিওগুলোর জন্মদাতা সবাই এই হাওরেরই মানুষ!
বলতে পারেন, এর আগে এই বৈশাখে কি বৃষ্টি-বাদল হয়নি কিছু? হ্যাঁ, হয়েছে অনেক। হয়েছে যখন পরিণতির কথা কৃষক কাউকে বলতেও যায়নি, দেখাতেও যায়নি। এমন সেলফিস জাতির কাছে কৃষকের দুঃখ বললেই কী হতো, দেখালেই বা কী হবে!? ত্রাণ নিয়ে আসতেন, এইতো বলবেন? নির্বিঘ্নে ফসল তুললে এই হাওরের মানুষ যে পরিমাণ দান-ছদকা করে সে পরিমাণ ধান ত্রাণ কোম্পানির অনেকে সারা জীবনে চোখেও দেখেনি হয়তো। অনেকেই আছেন উসর হিসেবে ২০ ভাগের একভাগ ধান দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে থাকেন এই বৈশাখে। তাদের কাছে ২/৪ কেজি চাল-মুড়ি-গুড় কেমন ব্যাপার চিন্তা করেন?
এত কথার পরও বৃষ্টির জন্য কারো কারো আবার পশুপাখি প্রেম উতলে উঠবে। এই বৈশাখে পশুপাখির কথা চিন্তা করে নাকি বৃষ্টি চাইবে তারা। যারা হাওরাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের অন্ন সংগ্রহের মৌসুম জানে না, তাদের মনে পশুপাখির প্রেম উতলে উঠছে, শুনতে তো বেশ ভালোই লাগে!
জেনে রাখুন, এই মৌসুমে হাওরের পশুর খাবার এত বেশি পরিমাণে থাকে যে, গরু-বাছুরকে রাখাল ছাড়াই উন্মুক্ত ছেড়ে দেওয়া হয় মাঠে। পাকা ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে গেলেও নরম ঘাসের আধিক্যের কারণে ধানে মুখ দিয়েও দেখে না এসব অবলা পশু। ধান কাটার পর এত পরিমাণ পোকামাকড় কীটপতঙ্গ বের হয়ে আসে যে, ক্ষেতের ঝড়া ধান তো পরের কথা, ধানের ঢিবি থেকে পোকামাকড় বেছে বেছে খায় কিন্তু এতটুকু ধান মুখে নিয়েও দেখে না কোনো হাঁস-মোরগে। বন্য পাখিদের খাবারের ব্যাপারটা কেমন হবে তখন, বুঝে নিন এবার। শীতের হাওরে এত এত অতিথি পাখির আনাগোনা কেনো এবার বুঝলেন কিছু? ক্ষেতে ঝড়া ধানে বিস্তির্ণ হাওরের নরম মাটি পরতে পরতে ছেয়ে থাকে সেও একটা বড় কারণ। পাখি শিকারি না থাকলে দিনদিন অতিথি পাখিতে আরো সয়লাব হতো এই হাওরগুলোতে। কিন্তু… এই বৈশাখেই বৃষ্টি হলে; পানি এলে সকল হিসাব নিকাশ উল্টে যাবে; উল্টে যেতে বাধ্য।
এরপরও বৈশাখে বৃষ্টি প্রার্থনা করবেন, করতে থাকুন। আপনি আমাদের আদর্শ কেউ, কেবল এটা মারাইতে আইসেন না। আপনি আলিম হন আর জালিম হন। অন্তত এই হাওরাঞ্চলের কৃষকের কাছে কোনোভাবেই না।
যারা হাওরবাসীর চাহিদা বুঝে না, সময় জ্ঞান নেই, প্রয়োজন সম্পর্কে বেখবর, যুগযুগ ধরে চলে আসা বোরো ধানের মৌসুমটাই চিনে না, কোন ঋতুর কি বৈশিষ্ট্য সেটাও জানে না, গ্রীষ্মে এসে বর্ষার আরাম খুঁজে, তারা মানুষ তো ঠিকই, ন্যূনতম জ্ঞানহীন মানুষ। এদের সাথে হাওরবাসীর কী সম্পর্ক একটু বলুন তো শুনি?
-এবিএম আল-আমীন চৌধুরী
সহকারী অধ্যাপক, ইটাখোলা ফাজিল মাদরাসা মাধবপুর, হবিগঞ্জ।