জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

মধুমাখা একটি নাম মা

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিকঃ পৃথিবীর সবচেয়ে মধুমাখা একটি নাম মা। মা‘য়ের মতো এমন মধুর শব্দ অভিধানে দ্বিতীয়টি পৃথিবীর কোথাও নেই। ‘মা’ শব্দটি ছোট কিন্তু এর বিশালতা আকাশের চেয়েও বড়। ‘মা’ বলতেই চোখের সামনে মা‘য়ের সদা হাস্যময়ী ও জান্নাতি চেহারা ভেসে ওঠে। ‘মা’ শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সব মায়া, মমতা,শীতল পরশ, অকৃত্রিম স্নেহ, আদর, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।

কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘তোমার প্রতিপালক এ আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাকে ভিন্ন অপর কারও ইবাদত করো না। পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করো। যদি তাদের একজন অথবা উভয়ই তোমার নিকট উপনীত হয়; তবে তাদের কখনো ‘উহ’ শব্দ পর্যন্ত বলবে না। তাদের ধমক দেবে না বরং তাদের সঙ্গে মার্জিত কথা বলবে। আর তাদের উদ্দেশ্যে অনুগ্রহে বিনয়ের বাহু অবনমিত করবে। আর বল, (তাদের জন্য দো‘য়া কর) হে আমার প্রতিপালক তাদের উভয়কে অনুগ্রহ কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছে’। (সুরা বনী ইসরাঈল, আয়াত:২৩-২৪)।

মা‘য়ের তুলনা মা নিজেই। মা‘য়ের কোনো বিকল্প নাই। পৃথিবীতে বাবা-মা‘য়ের ভালোবাসার সঙ্গে কোন কিছুর তুলনা প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু এর গুরুত্ব এবং মযার্দা কতটুকু তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। নদীর তলদেশ নির্ণয় করা গেলেও মা‘য়ের ভালোবাসার গভীরতা পরিমাপ করা যায় না।

এমন দয়ালু এবং মযার্দাবান মানুষটিকে আমরা কতটা সম্মান এবং ভালোবাসা দিচ্ছি? আমাদের যে ‘মা’ দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে তিল তিল করে আমাদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই মা‘য়ের কষ্ট বহুগুণে বেড়ে যায়। রাতের পর রাত জেগে সন্তানের দেখভাল করলেও মায়ের কোনো ক্লান্তি হয় না। সন্তানের সুখের জন্য হাসিমুখে সব কিছু বিলিয়ে দিতেও ‘মা’ কার্পণ্য করেন না।

সন্তানের সঙ্গে মা‘য়ের নাড়ির যে সম্পর্ক রয়েছে তা কখনো ছিন্ন হবার নয়। এই সুন্দর পৃথিবীতে মুক্তভাবে শ্বাস নিতে দিচ্ছে, আমরা সেই ‘মা’কে বিনিময়ে কি দিচ্ছি? আমরা বিনিময়ে আসলে কিছুই দিতে পারব না। কারণ মা‘য়ের ঋণ কেউ শোধ করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।

মা‘য়ের জগৎ হল তাঁর সন্তান, তেমনি সন্তানের কাছে তার ‘মা’-ই সব। ‘মা’ এবং সন্তানের মধ্যকার সর্ম্পক সবচেয়ে মধুর। একটি সন্তান যখন খেতে পারে না কথা বলতে পারে না এমন কি নিজের কাজ নিজেও করতে পারে না তখন তাকে আগলে রাখেন মমতাময়ী ‘মা’।

পরম মমতার চাদরের উষ্ণতায় আগলে বড় করেন। সব আবদার ‘মা’ হাসি মুখে মেনে নেন। আমাদের যতটুকু মা‘কে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার কথা ততটুকুই কেউ সঠিকভাবে দিই না। শত কষ্টের মাঝেও ‘মা’ তার সন্তানের গায়ে একফোঁটা আঁচড় লাগতেও দেয় না। সন্তানের হাসি মায়ের হাসি হয়ে যায়।

আবু উমামা (রা:)- হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুল (সা:)- কে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, সন্তানের উপর পিতা-মাতার কী হক আছে? তিনি বললেন তারা তোমার জান্নাত ও জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ)।

আবু হুরায়রা (রা:)- হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা:)- আমার সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার কে? রাসুল (সা:)- বললেন, তোমার ‘মা’। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, অতঃপর কে? রাসুল (সা:)- বললেন তোমার ‘মা’। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে? এবারও জবাব দিলেন, তোমার ‘মা’। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কে? এবার রাসুল (সা:) জবাব দিলেন, তোমার ‘বাবা’। (বুখারী ও মুসলিম)।

সন্তানের শৈশব-কৈশোর আবর্তিত হয়ে ‘মা’কে ঘিরেই। ‘মা’ তারুণ্যের পথপ্রদর্শক ও প্রেরণার উৎস। সন্তানের পাশে চাদরের মতো জড়িয়ে থাকেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ‘মা’ উচ্চারণ করার মধ্যেই অবধারিত সুখের ও শান্তির সন্ধান পাওয়া যায়। সে কারণে একটু আঘাত পেলে মনের অজান্তে মুখ থেকে ‘মা’ শব্দটি উচ্চারিত হয়। কিন্তু মা‘য়ের ভালোবাসা একবার হারিয়ে গেলে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।

শিশুকাল থেকে এ পর্যন্ত মায়ের কাছে হেরেই গেলাম জিততে পারিনি। একশ্রেণির মানুষ ক্ষমতার দাপটে অন্ধ হয়ে যায়। এই মুহূর্তে আমার জনম দু:খিনী মা‘য়ের কথা মনে পড়ে গেল। যে কোন দুর্ঘটনা কষ্টের আর তা যদি হয় ‘মা’ জননী তাহলে তো সহ্য করা কঠিন।

২০০৬ সালের ১২ জুন আমার গর্ভধারীনি ‘মা’কে চিরদিনের জন্য এবং ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর মাথার ছাতা প্রিয় ‘বাবা’কে হারিয়ে এতিম হলাম। প্রতিটি সন্তান জানে ‘মা’ আমাদের জন্য কতটা কষ্ট করে এবং কতটা ভালোবাসে।

প্রশ্ন হলো আমাদের মা‘কে কতটা ভালোবেসেছি? ‘মা’ তো তাঁর ভালোবাসা অন্তরে জমা রাখেনি, তাঁর ভালোবাসা দিচ্ছেন নিঃশ্বার্থ ভাবে। আমরা কিছু সন্তান রয়েছি মা‘কে ভালোবাসতে পারি না বরং কষ্ট দিতে জানি।

বর্তমান সমাজে লোক দেখানো ভালোবাসা মা‘য়ের প্রতি দেখাই। ‘মা দিবসে’ লাফিয়ে লাফিয়ে বলি ‘মা’ আমি তোমাকে ভালোবাসি। আবার স্যোশাল মিডিয়ায় ও ফেসবুকে মা‘য়ের জন্য ভালোবাসার বাণী লিখে প্রচার করি। আমরা অসুস্থ হলে ‘মা’ আমাদের জন্য জীবনটা দিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকেন।

‘মা’ আমাদের জন্য কি করে কিংবা কেমন করে সেটা আমরা ভালো ভাবেই জানি। কিন্তু আমরা মায়ের অসুস্থতার সময় কি করেছি? কখনো জানতে চেষ্টা করেছি ‘মা’ তুমি কেমন আছো?’। কখনো কি জানতে চেষ্টা করেছি ‘মা’ তোমার শরীর ভালো আছে কি?’

আমাদের সামান্য মাথাব্যথা হলেও মাকে এসে বলি, ‘মা আমার ভালো লাগছে না’। কিন্তু মায়ের গুরুতর অসুখের কথাও আমাদের কখনো বলে না কিংবা আমরা জানতে চেষ্টা করি না। শরীরে অসুস্থতা নিয়েও রান্না করে যায় প্রিয় খাবারটি। ঘরের সব কাজ নিশ্চুপভাবে করে যায়।

মা কখনোই বুঝতে দেয় না কষ্ট হচ্ছে বা আর পারছে না। আমরা কয়জনেই বা বুঝতে চেষ্টা করি। তখন নিজেরা একটু বেশিই বুঝি এরপর মায়ের ভুল ধরি এবং ধমক দিতে শুরু করি।

মা আমাদের কিছু বারণ করলে সেটা তোয়াক্কা করি না। নিজেদের মতো নিজেরাই চলি। চিন্তা করিনা আমাদের যে মানুষটি শূন্য থেকে এই পর্যায়ে আসতে সাহায্য করেছে তাঁর জন্য কিছুই করতে পারি না। এদিক থেকে চিন্তা করলে আমরা নিজেরাই বিবেকহীন অসৎ।

আজ আমাদের যাদের মা নেই। যখন ছিল তখন হয়তো সেই সুযোগটি পাইনি। আজ সময় এসেছে কিন্তু ‘মা’ নেই। হাজারো ‘মা’ হারানো সন্তান সমাজে রয়েছে। যাদের আছে তারা মা‘কে কতটুকু সম্মান কিংবা ভালোবাসা দিচ্ছি।

সমাজে এমনও কিছু সন্তান রয়েছে যারা তার জন্মদাত্রী মা‘য়ের শরীরে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু সেই ‘মা’ গুলোর অপরাধ কি, সন্তানকে জন্ম দেওয়া, শিশু কালে লালন পালন, নিজে না খেয়ে খাওয়ানো।

মা কখনোই শাস্তি দেয় না। সন্তানের জন্য মা‘য়ের মনে ভালোবাসা ব্যতীত কিছুই থাকে না। বরং অপরাধ করলে মা ক্ষমা করে দেন। ‘মা’ শুধু চায় সন্তান ভালো ও সুন্দর থাক। মা যদি না ফেরার দেশেও চলে যায় সন্তানের মঙ্গল কামনা সেখান থেকেও করবে। কারণ সে তো মমতাময়ী ‘মা’। ‘মা’ চায় তাকে ‘মা’ বলে ডাকি আর একটু ভালোবাসি।

কিন্তু আমরা মাকে ‘মা’ ডাকার মতো সময়ও আজকাল পাই না। ‘মা’ তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে অনেক অনেক খুঁজি আমরা, কিন্তু পাবো না। আমি পেয়ে হারিয়ে ফেলছি তোমাকে। জানি সন্তান মা‘কে কষ্ট দিয়ে থাকলেও ‘মা’ সেটা ভুলে যাবে এবং সন্তানকে ক্ষমা করে দিবে। এটাই মা‘য়ের নিয়ম। আজ বলতে চাই, ‘ক্ষমা করে দিও মাগো’। ‘মা’ তোমায় সত্যি ভালোবাসি।

লেখক: প্রাবন্ধিক