এম এ মজিদঃ আমার কাছে ৩টি মামলা রয়েছে যে মামলা গুলোর ৩ ভিকটিম অবিবাহিত অবস্থায় সন্তানের মা হয়েছেন। ২টি মামলায় ২ ভিকটিমকে তাদের সন্তানের পিতৃপরিচয় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। যদিও সংসারগুলো কোনো মতে টিকে আছে।
কেস স্টাডি-১ঃ নুরুন নেছা নামের এক মানসিক ভারসাম্যহীন অতিশয় গরীব এক অবিবাহিতা মেয়ের মামলা নিয়ে আমি চরম বিপাকে পড়ি। নুরুন নেছার মাও মানসিক ভারসাম্যহীন। বাবা নেই, ভাইও নেই। একটি ঝুপড়ি ঘরে মা মেয়ের বসবাস।
আশপাশের মানুষ তাদেরকে কিছু দিলে খায়, না দিলে উপোষ থাকে। এরই মধ্যে নুরুন নেছার প্রতি পাশের বাড়ির জসিম নামের এক যুবকের কুনজর পড়ে। তাদের মধ্যে মিলন হয়। এক পর্যায়ে নুরুন নেছা অন্তঃস্বত্বা হয়ে পড়ে।
৭ মাসের অন্তঃস্বত্বা থাকাকালীন আমি নুরুন নেছার মামলা শুরু করি। আদালত মামলাটি এফআইআর এর নির্দেশ দেন। দীর্ঘদিন আসামী গ্রেফতার হয়নি।
ইতিমধ্যে নুরুন নেছা অতিশয় সুন্দর এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। নাম রাখা হয় মধুমালা। মধুমালা জন্মের পর আসামী জসিম পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়।
আসামী পক্ষ চ্যালেঞ্জ করে যে, নুরুন নেছার গর্ভজাত সন্তানের জৈবিক পিতা জসিম উদ্দিন নয়। আসামী পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে ডিএনএ টেষ্ট করা হয় জসিম উদ্দিন, নুরুন নেছা ও মধুমালার।
বেশ কিছুদিন পর রিপোর্ট আসে নেগেটিভ। অর্থাৎ মধুমালার জৈবিক পিতা জসিম উদ্দিন নয়। পুলিশ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়। নুরুন নেছাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, এ ঘটনায় আর কেউ জড়িত কি না।
নুরুন নেছার একই জবাব, জসিম উদ্দিনই তার সাথে মিলন করেছে। নুরুন নেছার আত্বীয় স্বজন তাকে ভয়ভীতি দেখিয়েও জসিম উদ্দিনের নাম ব্যতিত অন্য কারও নাম আনতে পারেনি।
আমিও তাকে অনেকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম, মিথ্যা মামলা করলে সে জেলে যেতে পারে বলেও জানালাম, তারপরও তার একই কথা জসিম উদ্দিনই দোষী, অন্য কেউ নয়।
গত ৬ ডিসেম্বর আসামীর জামিন শুনানী হয় উচ্চ আদালতে। আসামী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগন জোড়ালো ভাবেই তাদের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করলেন।
আমি শুধু নুরুন নেছাকে আদালতের সামনে উপস্থাপন করে বললাম, সে মানসিক ভারসাম্যহীন, তাকে টাকা দিলে সে টাকাও নেয় না, খাবার দিলে ভালভাবে খায়ও না, জসিম উদ্দিনকে ফাসানোর পিছনে তার কোনো দুরভিসন্ধি থাকতে পারে না।
তাছাড়া যে কোনো এক্সপ্রার্ট ওপিনিয়ন বিজ্ঞ আদালতের বিচারিক কার্যক্রমকে সহযোগিতা করবে, কিন্ত তা চূড়ান্ত বলে কিছু নয়। পারিপার্শিক অবস্থা বিবেচনায় বিজ্ঞ আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
আমি আসামীর জামিনের বিরোধীতা করলাম। আদালত আসামীকে জামিন দেননি। শুনানী শেষেই সিনিয়র আইনজীবী চৌধুরী আশরাফুল বারী নোমান ও সিনিয়র আইনজীবী ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন-ডিএনএ রিপোর্ট নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। তাদের কাছে এ সংক্রান্ত বিষয়ে পৃথক মামলা রয়েছে।
চেম্বার থেকে কোর্ট, এই কয়েকটি ঘন্টা সময় আমি দেখলাম, মধুমালার যত্বে নুরুন নেছা কোনো আপোষ করেনি। সবসময় আগলে রেখেছে, ক্ষিধার সময় কোর্টের ভেতরেই আড়ালে বসে খাইয়েছে। আমি মানসিক ভারসাম্যহীন নুরুন নেছাকে একজন প্রকৃত মা হিসাবেই দেখেছি।
কেস স্টাডি-২ঃ একটি ধনীক পরিবারের ছেলে আমার সাথে কথা বলতে চায় একান্তে। কিন্তু চেম্বারে এসে দেখে আমি বিজি, চলে যায়। এভাবে ২/৩দিন ঘটেছে।
আংশিক কথাবার্তায় আমি বুঝলাম, তার কলেজ পড়ুয়া বোন কোর্ট ম্যারেজ করেছে, এখন তারা তালাক দিতে চায়। তারপরও ছেলেটি আমার সাথে একান্তে কথা বলবেই।
একদিন সন্ধার পর ছেলেটি আসল, আমিও ছিলাম একা। সে আমাকে বলল, ভাই বিপদে পড়ে গেছি, কয়েকটি কাজ আপনাকে করতে হবে, যত টাকা লাগে আমরা খরচ করবো।
তারপর জানলাম, তার কলেজ পড়ুয়া বোন গ্রামের এক ছেলের সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছে। ছেলেটি তাদের পরিবারের তুলনায় অনেক নিচের। এই বিয়ে তারা কোনো ভাবেই মেনে নিবে না।
বললামঃ তালাক দিয়ে দাও, তাহলেই শেষ।
সে বলল, না, আরও কিছু প্রবলেম আছে। বোনের ঘরে এক সন্তান হয়েছে।
বললাম, সেটাও কোনো সমস্যা না, তোমাদের আর্থিক সংগতি থাকলে ছেলের কাছ থেকে ভরণ পোষনের টাকা না আনলেই হল।
বলল, আরও প্রবলেম আছে ভাই, জন্মের পরই আমরা সন্তানটিকে অন্যত্র পালক (দত্বক) দিয়ে দিয়েছি।
আমি জানতে চাইলাম, তোমার বোনকি তাতে রাজী ছিল।
বলল, তার সম্মতিতেই সন্তানটিকে দত্বক দেয়া হয়েছে। মনটা ভিশন খারাপ হয়ে গেল আমার।
জানতে চাইলাম, এখন সে কি চায়?
বলল, আমরা তাকে বুঝিয়েছি, সেও বুঝেছে, সামনে তার উজ্জল ভবিষ্যত, বিয়েটা আমরা অস্বীকার করতে পারব, তালাকও দিতে পারব, কিন্তু সন্তান তো অস্বীকার করতে পারব না, তাছাড়া সন্তানসহ তো ভাল জায়গায় বিয়েও দেয়া যাবে না।
জানতে চাইলাম, সন্তানের বাবা তো জানে, তোমার বোন সন্তান জন্ম দিয়েছে। বলল, এক্ষেত্রে আমরা একটু চালাকি করেছি। সন্তান জন্মের কয়েক মাস আগ থেকেই আমরা আমাদের বোনকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেই। সেখানেই সন্তান জন্ম লাভ করে। জন্মের পরপরই আমরা সন্তানটিকে দত্বক দিয়ে দেই। তা বোনের জামাই জানে না।
জানতে চাইলাম, তাহলে আমি কি উপকারে আসতে পারি? ছেলেটি জানালো- তার মা বাবা বোনের সাথে পরামর্শ করেই সে আমার কাছে এসেছে- বোনের সন্তানটি জন্মের পরই মারা গেছে এমন কোনো ডকুমেন্ট তৈরী করে দিতে পারব কি না। যত টাকা লাগে তারা খরচ করবে, সেটা লাখ টাকাও কোনো বিষয় না।
বিশ্বাস করুন, এ কথা শুনে তখন আমার শরীর অধিকহারে কাপছিল, আমি প্রচন্ডভাবে ঘামছিলাম, আমার চোখের সামনে থেকে নুরুন নেছা ও মধুমালাকে সরাতে পারছিলাম না। যে অবৈধভাবে সন্তান জন্ম দিয়েও অস্বীকার করেনি, দত্বকও দেয়নি, কোলছাড়াও করেনি, যার সামনে অন্ধকার ভবিষ্যত হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
অপরদিকে সুখের সন্ধানে সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া সন্তানকে দত্বক দিয়ে দিয়েছে কোটিপতির মেয়ে, আবার সুখের জন্য জীবিত সন্তানকে মৃতও দেখাতে চায়।
আমি অভদ্র ভাষায় ছেলেটাকে ধিক্কার জানাতে লাগলাম। একই সাথে নিষ্পাপ শিশুর প্রতিটা কান্না, চোখের পানি, মায়ের বুকের দুধ খেতে না দেয়ার অভিশাপ তার মা বাবা বোন এবং তার নিজের জীবনের সুখ শান্তি কেড়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট বলে জানিয়ে দিলাম।
গর্ভজাত সন্তানকে অস্বীকার করে, সুখের জন্য জীবিত সন্তানকে মৃত দেখানোর মতো স্পর্ধা যে মা দেখাতে পারে, সে আসলে মা কি না তা নিয়ে আমি সন্দেহের সাগরে ভাসতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম আসলে মা কত প্রকার?
লেখকঃ আইনজীবী ও সংবাদকর্মী