জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনে আনন্দের সংবাদ, প্রত্যাশাও অনেক

শাহ ফখরুজ্জামানঃ ঐতিহাসিককাল থেকেই ক্রীড়ঙ্গনের জনপদ হিসেবে পরিচিত হবিগঞ্জ জেলা। তবে অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা, পৃষ্ঠপোষকতা এবং ভালো উদ্যোগের অভাবে এখানকার ক্রীড়াঙ্গন প্রত্যাশিতভাবে অগ্রসর হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনে অনেক আনন্দের সংবাদ এসেছে।

এগুলো আমাদের স্বপ্ন দেখাতে সাহস দিচ্ছে। আবার এই সফলতাগুলো সাসটেনবল হবে কিনা, তা নিয়েও রয়েছে আশঙ্কা। কারণ অনেক সীমাবন্ধতা। যদিও এই সীমাবদ্ধতা চাইলেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন বাস্কবসম্মত উদ্যোগ। এই উদ্যোগ নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে প্রত্যাশাও অনেক।

মঙ্গলবার হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় খবরটি আসে ফুটবল থেকে। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ অনূর্ধ্ব-১৭ বালক প্রতিযোগিতা থেকে সারাদেশের বাছাই করা ৪০ জন ফুটবলার সুযোগ পায় বিকেএসপিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে ১১ জন ফুটবলার বাছাই করা হয়েছে ব্রাজিলে পাঠানোর জন্য। সেই ১১ জনের মধ্যে তিনজনই আমাদের হবিগঞ্জের সন্তান। ফুটবলের তীর্থভূমিতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগের তালিকায় নিজ জেলার তিনজনের সুযোগ পাওয়া নিঃসন্দেহে আনন্দের।

এখানে আরও লক্ষ্যণীয় বিষয় হল হবিগঞ্জ থেকে সুযোগ পাওয়া তিনজনই এসেছেন চুনারুঘাটে ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের ফুটবল একাডেমি থেকে। জেলা শহরের বাইরে এবং সীমিত অবকাঠামোগত সুবিধা নিয়েই শুধু ভালো উদ্যোগেই যে কতটা ভালো ফলাফল এনে দিতে পারে এটি একটি নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তাই ধন্যবাদ প্রাপ্য ব্যারিস্টার সুমনের। প্রশিক্ষক আব্দুল আজিজও ধন্যবাদ পাবেন নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার জন্য।

এখানে আরও একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হল চুনারুঘাট থেকে যে তিনজন সুযোগ পেয়েছেন, তার মধ্যে দুইজনই ক্ষুদ্র নৃ-তাত্বিক জনগোষ্ঠীর। অনিক দেব বর্মা সুমনের বসবাস পাহাড়ে আর শংকর বাকতি (মধু) চা শ্রমিক সন্তান। তাদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে।

ফুটবলের বড় বড় মহাতারকাদের উঠে আসার গল্পও কিন্তু অনিক আর শংকরের মতোই। পেলে আর ম্যারাডোনার গল্পগুলো সবাই জানে। বস্তি থেকে প্রতিকূলতা জয় করেই তারা বিশ্ব শাসন করেছেন। তাই প্রকৃত তারকার সন্ধান করতে হলে আমাদের ছুটতে হবে সেই দুর্গম এলাকাতেই। শহরে বসে বড় তারকা বের করা যাবে না। এটি আমাদের শিক্ষা দিলেন অনিক আর শংকর। এই বিষয়টির প্রমাণ কিন্তু মিলেছে অনেক আগেই।

চুনারুঘাটের চা কন্যারা আমাদের হবিগঞ্জকে বার বার প্রমিলা ফুটবলে সিলেটের সেরা বানিয়েছেন। বাহুবল উপজেলার আলিয়াছড়ার খাসিয়ারাও বঙ্গবন্ধু ফুটবলে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়ে একবার প্রমাণ করেছেন তারা সুযোগ পেলে কী করতে পারেন। ব্যারিস্টার সুমন সেই সম্ভাবনার জায়গাটি ঠিকই ধরতে পেরেছেন। এই সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করলে আরও শংকর ও অনিক সৃষ্টি হবে, তা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

মঙ্গলবার হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনে আরও একটি ভালো খবর আসে ময়মনসিংহ থেকে। ময়মনসিংহ স্টেডিয়ামে জাতীয় ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে হবিগঞ্জ জেলা ক্রিকেট দল রাঙ্গামাটিকে ৮ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে। এর আগে একই মাঠে সুনামগঞ্জকে ২ উইকেটে পরাজিত করেছিল হবিগঞ্জ। ৯ এপ্রিল কক্সবাজারের মুখোমুখি হবে হবিগঞ্জ। সেই খেলায় জয়লাভ করলে অথবা অন্যান্য দলের ফলাফল বিশ্লেষণে আমাদের সুযোগ হতে পারে জাতীয় ক্রিকেট লিগের টায়ার-১ এ অংশ নেওয়ার।

হবিগঞ্জ যেদিন রাঙ্গামাটিকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করল সেই খেলায় ছিলেন না এই মুহূর্তে জেলার সেরা খেলোয়াড় জাকের আলী অনিক। ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে ওইদিন ছিল মোহামেডান ও আবাহনীর লড়াই। আমাদের অনিক ৬০ রান সংগ্রহ করে আবাহনীকে ৬ উইকেটে জয়লাভ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ খবরটিও আমাদের জন্য আনন্দের।

ফুটবল, ক্রিকেটের পাশাপাশি অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতার প্রতিযোগিতায়ও অনেক সাফল্য এসেছে গত কয়েকদিনে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতার প্রতিযোগিতায় হবিগঞ্জে অনেক পুরস্কার এসেছে। কয়েকদিন আগে সিলেটে অনুষ্ঠিত সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তানের সন্তানদের অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় হবিগঞ্জ জেলা সেরা হয়েছে। অন্য খেলায়ও ছোট বড় সফলতার খবর আসছে প্রতিনিয়ত।

ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির সর্বোচ্চ পর্যায়ে সুনাম কাড়ছেন আমাদের অনেক খেলোয়াড়। ভলিবলের জাতীয় স্কোয়াডেও আছেন প্রতিনিধি। ভারউত্তোলনে মুমিনসহ বিভিন্ন ইভেন্টে দেশের প্রতিনিধিত্বকারী রয়েছে হবিগঞ্জের অনেকেই। দেশের সীমানা পেরিয়ে ইংলিশ লিগের সাবেক চ্যাম্পিয়ন লেস্টার সিটির হামজা আমাদের সন্তান।

এই মাটিতেই বেড়ে ওঠা নিপু এখন পর্তুগালে জাতীয় দলের ক্রিকেটার। পিএইচডি করতে গিয়ে ফিনল্যান্ড জাতীয় দলে অংশ নিচ্ছেন হবিগঞ্জের নুরুল হুদা শিপন। হবিগঞ্জের আরও অনেক ক্রিকেটার বিদেশের বিভিন্ন লিগে অংশ নিচ্ছেন।

আমাদের নাজমুল হোসেন এখন এ দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যারিস্টার সুমনের মতো তিনিও চুনারুঘাটের চা বাগান ঘেরা মাঠে একাডেমি করে নতুন ক্রিকেটার সৃষ্টির জন্য মনোনিবেশ করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনে এগিয়ে যাওয়ার সংবাদই পাওয়া যাচ্ছে বেশি।

হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনের এই অগ্রযাত্রার অন্যতম নিয়ামক হবিগঞ্জ আধুনিক স্টেডিয়াম। হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহিরের প্রচেষ্টায় এই স্টেডিয়াম হওয়ার পর এখন দ্রুত বিকাশ হচ্ছে খেলাধুলার। ছোট্ট জালাল স্টেডিয়ামে এক সময় অর্ধশত রান করতে যেখানে খেলোয়াড়দের সংগ্রাম করতে হত, সেখানে আধুনিক স্টেডিয়ামে এ বছর হয়েছে ৮টি সেঞ্চুরি। জেলা দলের তৌফিক এক ইনিংসে ২৫১ রান করে সবাইকে তাক লাগিয়েছেন।

এমপি আবু জাহির এই মাঠকে আরও উন্নত করে এবং বাহুবলের প্যালেস রিসোর্টকে কেন্দ্র করে আমাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আন্তর্জাতিক খেলাধুলা আয়োজনের। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার এই ঘোষণা আমাদের আশাবাদী করেছে।

তিনি শুধু মাঠই এনে দেননি। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চাহিদার বিষয়টি জানা থাকায় পৃষ্ঠপোষকতার হাতও বাড়ান নিয়মিত। তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা হবিগঞ্জ আধুনিক স্টেডিয়ামে মিডিয়া সেন্টার স্থাপনসহ অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য যেন আরও উদ্যোগ নেন। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন একটি ইনডোর স্টেডিয়াম।

বাংলাদেশে যেসব খেলা আয়োজন করা হয়, তার অধিকাংশই ইনডোর। আউটডোর খেলার সংখ্যা তুলনায় কম। আবার যারা আউটডোর খেলায় অংশ নেন তাদেরও প্রস্তুতি নিতে যেতে হয় ইনডোরে। বিশেষ করে বর্ষাকালে ক্রিকেটারদের নিজেদের দক্ষতা ধরে রাখা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ইনডোরের ওপর নির্ভর করতে হয়।

মৌসুমী খেলোয়াড়কে পেশাদার খেলোয়াড়ে রূপান্তর করার পূর্বশর্ত হল ইনডোর স্টেডিয়াম এবং মানসম্মত জিমনেশিয়াম। এর বাইরে একটি সুইমিংপুলের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। হাওর এলাকার প্রাণকেন্দ্র হবিগঞ্জ শহরে একসময় পুকুরে ভরপুর ছিল। এখন অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে।

প্রতিযোগিতার জন্য সাঁতারু সৃষ্টি করা এখন দুরূহ ব্যাপার। কারণ শহরে থাকা নতুন প্রজন্মের অনেকেই সাঁতারই জানে না। সুইমিংপুল করতে পারলে শুধু সাঁতারুই সৃষ্টি হবে না, এতে অন্য খেলার খেলোয়াড়রাও তাদের ফিটনেসের উন্নতির জন্য ব্যবহার করতে পারবেন।

হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনের এই অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে হলে ইনডোর স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম ও সুইমিংপুল বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। আমার জানামতে এ ব্যাপারে বিগত সময়ে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও নিয়মিত তদারকির অভাবে কোনো অগ্রগতি নেই। আমাদের এমপি মহোদয় উদ্যোগ নিলে অবশ্যই তা বাস্তবায়ন হবে।

এই মুহূর্তে আমাদের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান মহোদয়ও খেলাধুলায় উৎসাহী। নিয়মিত খেলার বাইরে ঘোড়দৌর ও লাঠিখেলার মতো গ্রামবাংলার জনপ্রিয় খেলাকে গ্রাম থেকে শহরে এনে ক্রীড়াঙ্গনে নতুনত্ব এনেছেন। প্রথমবারের ন্যায় আয়োজন করেছেন বিভাগীয় টেনিস প্রতিযোগিতা। ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে তার কাছে যথাযথ সমন্বয় প্রত্যাশা করছি।

খেলাধুলার সফলতা নিয়ে এই লেখার  অবতারণা হলেও এই সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রেও ভাল কিছু সংবাদ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। একটি হল এবার হবিগঞ্জ থেকে রেকর্ডসংখ্যক শিক্ষার্থী সুযোগ পেয়েছেন সরকারী মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নের। আরেকটি হল ৪০তম বিসিএস এর ফলাফলে হবিগঞ্জ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সুপারিশ হওয়া।

আরেকটি বিষয় লিখে শেষ করতে চাই, সেটি হল হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহিরের কাছে একটি প্রত্যাশা। তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় উদ্যোগ নিয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছেন। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তার নামেও হয়েছে। আলেয়া জাহির ফাউন্ডেশন করে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

খেলাধুলার উন্নয়নে যদি তিনি একটি একাডেমি গড়ে তুলেন, তাহলে হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গন অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এই একাডেমি হবে বিকেএসপির আদলে, যেখানে এসে ভর্তি হয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলা শিখবে শিশুরা।

সিলেটে রাগীব রাবেয়া একাডেমি যেভাবে কাজ করে সেই আদলে একটি প্রতিষ্ঠান করলে তা শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রযাত্রায়ও বড় ভূমিকা রাখবে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এনে দেওয়াসহ বিগত সময়ে তার কাছ থেকে বড় বড় উপহার পাওয়ায় এই চাওয়াটুকুও পূরণ হবে বলে আমি আশাবাদী। কারণ যিনি কাজ করেন এবং করতে পারেন, তার কাছে প্রত্যাশাও অনেক।

লেখক: আইনজীবী, সাংবাদিক ও সহ-সভাপতি, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, হবিগঞ্জ।