সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকনঃ মাবিয়া খাতুন। বয়স ১০৫। বয়সের ভাড়ে নূইয়ে পড়েছেন। ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। নিজের পায়ে হাঁটারও মুরদ নেই। থাকেন ছেলের আশ্রয়ে। পান ব্যবসা করে অনটনে চলে ছেলের সংসার। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সহ্য করতে হয় পুত্রবধূর অত্যাচার। শেষ পর্যন্ত ছেলে আর ছেলের বউ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। রেখে আসে গাছতলায়।
খবর পেয়ে সেখান থেকে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে দেন পুলিশ সুপার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা। তাকে দেয়া হয় হুইল চেয়ার, নতুন শাড়ী, খাবার ও নগদ অর্থ। এ সময় ছেলে আর ছেলের বউ পুলিশের কাছে অঙ্গীকার করেন বৃদ্ধা মায়ের সাথে কখনও খারাপ আচরণ করবেন না। এদিকে গাছতলা থেকে বাড়ি ফিরে আনন্দে উদ্বেলিত মাবিয়া খাতুন। এবার সেই বৃদ্ধার পাশে দাঁড়ালো প্রবাসীরা।
প্রবাসীদের প্রতিষ্ঠিত সিলেটের জকিগঞ্জের ডা. আব্দুল হান্নান ট্রাস্ট তার খাবার, চিকিৎসাসহ ভরণপোষণের জন্য ১ লাখ টাকা অনুদান দেয়। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মাধ্যমে তা পৌছে দেয়া হয়। এছাড়া বৃদ্ধা মাবিয়ার সেবা করার জন্য স্থানীয় একজন মেয়েকে মাসিক বেতনের ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছেন থানার ওসি মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি নিজে তার বেতন পরিশোধ করবেন বলে জানান।
আনন্দে উদ্বেলিত মাবিয়া খাতুন বলেন, আমার বয়স ১শ’ ছাড়িয়েছে। আমার ছেলে ভালো হলেও পুত্রবধূ আমাকে খেতে দিতোনা। এমনকি এক গ্লাস পানিও দিতোনা। আমি অসুস্থ, চলতে পারিনা টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিলাম না। এবার আমার সব সুযোগ হয়েছে। বাড়িতে উঠতে পেরেছি। খাবার পাচ্ছি। সেবা পাচ্ছি। এ সময় পুলিশ সুপারকে হাত ধরে তাকে বাবা সম্বোধন করে কেঁদে ফেলেন বৃদ্ধা মাবিয়া।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বলেন, ছেলে আর ছেলের বউ মাকে গাছতলায় রেখে এসেছে, ফেসবুকে এমন মর্মান্তিক খবর দেখে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহন করি। বৃদ্ধার চলাচলের জন্য হুইল চেয়ার ও তার চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। আর্থিক অনটন এবং সামাজিক অবক্ষয় থেকেই মা বাবার প্রতি সন্তানরা এমন আচরন করছেন বলে মনে করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যেকেরই যার যার অবস্থান থেকে এমন মানবিক কাজে এগিয়ে আসা উচিৎ।
মাধবপুর থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক জানান, পুলিশ সুপারের নির্দেশে বৃদ্ধার বিষয়টি অমরা সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষনে রাখছি। তার সেবা করার জন্য একজন মেয়েকে মাসিক বেতনের ভিত্তিতে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ওই মেয়ের মাসিক বেতন আমি নিজে পরিশোধ করবো।
সিলেটের জকিগঞ্জের ডা. আব্দুল হান্নান ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহসিন জানান, পুলিশ সুপারের ফেসবুক পেজে দেখে জানতে পারেন এমন অমানবিক ঘটনার খবর। এরপর তার বড় ভাই ট্রাস্টের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি আব্দুল মালিক নিজের বিবেকের তাড়ণা থেকে খবরাখবর নেয়ার জন্য বলেন। আমরা খবরাখবর নিয়ে জানালে ট্রাস্টের পক্ষ থেকে তার জন্য খাবার ও নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয়।
এ ধরণের মানবিক একটি কাজে অংশ নিতে পেরে আমরা আনন্দিত। তিনি বলেন, আমরা খাবার ও টাকা সেখান থেকেই দিতে পারতাম। কিন্তু এ রকম একটি কাজের জন্য পুলিশ সুপারকে উৎসাহ দিতে এবং অনুপ্রেরণা দিতেই মূলত এসব নিয়ে এখানে এসেছি।
জানা গেছে, জেলার মাধবপুর উপজেলার রিয়াজনগর গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধা মাবিয়া খাতুন। তার একমাত্র ছেলে তারা মিয়ার সাথেই থাকেন। তারা মিয়া একজন পান ব্যবসায়ী। কোন রকমে অভাব অনটনেই চলছে তাদের সংসার। এরই মাঝে তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুন শ্বাশুড়ির সাথে অসদাচরণ শুরু করেন। এক পর্যায়ে তাকে গ্রামের একটি গাছতলায় রেখে আসেন। বিষয়টি স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী এসএইচ উজ্জ্বল নিজের ফেসবুকে প্রচার করেন।
তা দেখে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন মাধবপুর থানার ওসি মো. আব্দুর রাজ্জাককে। ওসি ঘটনাস্থলে পৌছে বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে আপন ঠিকানায় পৌছে দেন। তিনি ছেলে ও ছেলের বউকে নিজেদের ভবিষ্যত পরিনতি কি হতে পারে তা বুঝান। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের ভুল স্বীকার করে আর এমন করবেন না বলে অঙ্গীকার করেন।
এদিকে ওই বৃদ্ধার সহায়তায় এগিয়ে আসে সিলেটের জকিগঞ্জের ডা. আব্দুল হান্নান ট্রাস্ট। রোববার প্রতিষ্ঠানটির একটি প্রতিনিধি দল খাবার হিসেবে ৩ বস্তা চাল, ১০ লিটার তেল, ছোলা, ডাল, চিনি, লবন, বিভিন্ন রকমের মসলাসহ ফলমুল নিয়ে হাজির হন পুলিশ সুপার কার্যালয়ে।
সেখানে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে অনুভূতি প্রকাশ করেন সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার মহসিন আল মুরাদ, মাধবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক, ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহসিন, সদস্য মো. হারুনুর রশিদ, সাংবাদিক মোহাম্মদ নাহিজ, মো. ফজলুর রহমান, হারুনুর রশিদ চৌধুরী, ব্যবসায়ী রোটারিয়ান আজহারুল ইসলাম উজ্জ্বল, জকিগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. ফেরদৌস আলম, সাংবাদিক আল মামুন, এনাম আহমেদ প্রমূখ। পরে ওই বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে এসব পণ্য ও টাকা পৌছে দেয়া হয়।