ছোট গল্প
মোটা বৌ
রেজওয়ানা আহমেদ
প্রথম অংশ
আনাম বিয়ে করেছে, সে তার বউকে খুব ভালোবাসে | বউ তার চেয়ে ডাবল মোটা, বিয়ের দিন রাতে খাট ভেঙে বউটি কোমরে ব্যথা পেয়েছে | আনাম স্ত্রীকে খুব যত্ন সহকারে সেবা করে সুস্থ করে তুলে |
গ্রাম থেকে আনামের মা তার চাচাতো ভাইকে সাথে নিয়ে আনামের বাসায় আসলেন | আনাম বউকে ডেকে বলল,রাবেয়া ( রাবেয়া আনামের স্ত্রীর নাম) মা এসেছেন ;
রাবেয়া এসে শাশুড়ীকে সালাম করে রান্নাঘরের দিকে এগুলো,
আনামের চাচাতো ভাই রাবেয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চেয়ে বলল, ভাইয়া – আমার শালীর কত চিমচাম ফিগার তবু ও তুমি বিয়ে করলেনা | এখন এই কি নিয়ে এসেছো? বাব্বাহ এত মোটা বউ –
আনাম ; তুই থামবি, তোর ভাবি খুব ভালো ও সংসারী মেয়ে, আর আমার সংসারী স্ত্রীরই দরকার |
চাচাতো ভাই ; ঠিক আছে ভাই, আমি এখন আসি পরে আসবো একদিন |
আনামের চাচাতো ভাই চলে যাওয়ার পর আনামের মা জাহেদা বললেন, বাবা তুই একি করেছিস? এত মোটা মেয়েকে কেন বিয়ে করলি?
আনাম ; মা, মেয়েটা সংসারী ও ভালো তাছাড়া তোমার খেয়াল রাখবে |
জাহেদা ; আচ্ছা বাবা, তুই ভালো থাকলে ভালো |
রাবেয়া নাস্তা বানিয়ে শাশুড়ীকে দিল |
আনাম যে অফিসে চাকরি করে সেখানে বলা হয়নি কাউকে বিয়ের ব্যাপারে, তাই চাচ্ছে অফিসের বসসহ সকল কলিগদের দাওয়াত খাওয়াতে | আনামের মা ও স্ত্রী এতে সায় দিলেন | পরের দিন রাবেয়া সব আয়োজন নিজ হাতে একা করল, অফিসের বস সহ সকল কলিগ রাবেয়ার খাবারের প্রসংশায় পঞ্চমুখ | কিন্তু খাবারের প্রসংশার সাথে সাথে রাবেয়াকে নিয়ে সবাই তামাশা করতে লাগলো | কেউ বলছে ভাবী মজার খাবার খেয়ে এত সুন্দর দেখতে, আবার কেউ বলছে আনামের সাথে একদম মানাচ্ছেনা এত মোটারে বাবা |
আনামের বসের বউ সুনিতা বলল, আমাকে না পেয়ে শেষ মেষ মোটা বউ |
আনাম ; তোমার লোভী নয়, আমার সাথে প্রেম করে টাকার লোভে অফিসের বসকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেছো | কিন্তু আমার বউ সংসারী | সব কিছু ও দেখাশুনা করে |
সুনিতা ; আচ্ছা – এত সংসারী তোর বউ, এত বড়াই করেছিলি আগে মনে আছে –
আমার থেকে সুন্দর বউ তুই বিয়ে করবি, এখন দেখতে পাচ্ছি কত সুন্দর তোর বউ – হা হা হা –
সবাই চলে যাবার পর রাবেয়া মন খারাপ করে বসে আছে, সবার কথা সে শুনেছে |
জাহেদা ; আনাম এদিকে আয় তো, আমি যা শুনেছি সব কি সত্যি?
আনাম ; কি কথা মা,
জাহেদা ; ঐ যে বসের বউয়ের সাথে তোর নাকি
সম্পর্ক ছিল, তাহলে ঐ মেয়েকে বিয়ে করলিনা কেন? দেখেছিস সবাই নিয়ে কি তামাশা করেছে, শুধু তোর মোটা বউয়ের জন্য |
আনাম ; মা সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো তোমার কত সেবা যত্ন করে, ——-চলবে
দ্বিতীয় অংশ
রাবেয়া সংসারের সব কাজ যত্ন সহকারে করেও শাশুড়ির খুব সেবা করে চলেছে | তবু ও শাশুড়ির মন ভরে না, রাবেয়াকে দেখতেই পারেনা |
আনাম অফিসে যাবার পর প্রতিনিয়ত তার বউকে নিয়ে সবাই তামাশা করে মোটা বলে | রাবেয়া আনামকে অফিসে খাবার পাটালে খায় না, সেই খাবার বাসায় ফেরত নিয়ে আসে | রাবেয়া বুঝতে পারে আনাম তাকে আগের মত আর ভালোবাসে না, রাবেয়া লুকিয়ে কাঁদে |
একদিন আনামের ছোট বোন শ্বশুর বাড়ি থেকে বাচ্চাদের নিয়ে বাবার বাড়ি এল | নিশু ( আনামের ছোট বোন) এসে রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে আদর করলো |
জাহেদা বেগম এসে মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, আর আদর করতে হবেনা ভাবিকে | ওর জন্য আমার ছেলে অফিসে মুখ দেখাতে পারেনা, সবাই নিয়ে মজা করে, সারাশরীরে চর্বিতে ভরা |
এই যাওতো ( রাবেয়াকে উদ্দেশ্য করে) আমার মেয়ের জন্য নাস্তা নিয়ে আসো |
রাবেয়া ; যাচ্ছি মা –
নিশু ; আচ্ছা মা, তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা ভাবির সাথে এমন ব্যবহার করছো কেন? তোমাকে কত খেয়াল রাখেন, কত ভালো ভাবি, শুধুমাত্র মোটা বলে তার সাথে এমন আচরণ করোনা | আর ভাইয়া কি?
একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে কেন এমন করছে ভাবির সাথে তাও আবার অন্যদের কথায় |
তার গুণের কোন মূল্য নেই তোমাদের কাছে?
জাহেদা বেগম ; তুই থামবি না আমি এখান থেকে চলে যাবো | আমি কি করবো? তোর ভাই তো অফিসে অপমানিত হয় |
রাবেয়া নিশুর জন্য নাস্তা নিয়ে আসে |
রাবেয়া ; নিশু খাও, এবার অনেক দিন থাকবে কিন্তু বলে দিলাম,
নিশু ; ভাবি, তোমার সাথে কিছু কথা আছে,
রাবেয়া ; বল,
নিশু ; ভাবি, ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে?
এই কথায় রাবেয়া কাঁদতে থাকে, ভাবি তুমি কেঁদনা , আমার কথা শোন | তুমি ডায়েট কর, ব্যায়াম কর | দেখবে একটু ওজন কমবে |
রাবেয়া ; আমি চেষ্টা করি নিশু, তবে সময় তো লাগবে, কিন্তু তোমার ভাই একথা বুঝেনা কেন? এত তাড়াতাড়ি কি স্লিম হওয়া যায়?
এক সপ্তাহ পর আনাম রাবেয়ার ওজন মাপে, কিন্তু রাবেয়ার ওজন কমেনি |
আনাম রাবেয়াকে ঠাস করে চড় মেরে বলল, আজ থেকে তোর খাওয়া বন্ধ এবং তোকে অন্য ওষুধ দেব দাঁড়া |
রাবেয়াকে টেনে টেনে আনাম বাসা থেকে বের করে নিয়ে একটা খোলা মাঠে দাঁড়ালো |
কল দিয়ে কয়েকজন বখাটে আনলো |
রাবেয়া ; তুমি কি করছো এসব | এগুলো তুমি ঠিক করছো না, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি বাবার বাড়ি চলে যাবো |
আনাম ; না ( হিংস্র পশুর মত) , হয় স্লিম হবি না হয় মরবি |
আনাম বখাটেদের বলল, তোমরা ওকে পেছন থেকে দৌড়াবে আর যখন থামবে তখন এই ছুরি দিয়ে পায়ে বা হাতে আঘাত করবে | তার বিনিময়ে তোমরা টাকা পাবে |
এদিকে নিশু ঘুম থেকে উঠে রাবেয়াকে ডাকছে,
ভাবি, ভাবি, ও ভাবি তুমি কোথায়?
সারা বাড়ি নিশু খোঁজ করে দেখে ভাবি নেই | নিশু আনামকে কল দিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি কি অফিসে?
আনাম ; কেন? কোন দরকার?
নিশু ; না ভাইয়া , আমি একটু ঘোরতে চাই | তুমি বাসায় আসো, ( নিশু বুঝতে পারলো আনাম রাবেয়াকে নিয়ে গেছে ) নিশু ভয় পাচ্ছে |
ভাইয়া যদি রাগের মাথায় ভাবির কোন ক্ষতি করে | নিশু মায়ের কাছে সব বলল |
মা ; নিয়ে গেলে যাক তোর সমস্যা কি? আমার ছেলে কত আফসোস করছে আর সে শুধু খাই খাই করে মোটা শরীর বানায় |
নিশু ; মা, তুমি এসব কি বলছো? আরে তোমার ছেলে তো নিজে দেখে মোটা মেয়ে বিয়ে করেছে এতে ভাবির দোষ কোথায়?
আমি এই বাড়িতে আর থাকবো না | তবে জানিনা তোমার ছেলে মেয়েটার সাথে কি করছে এখন ?
আমি যাই আগে তোমার ছেলের কাছে -|
নিশু আনামকে কল দিয়ে তার সাথে করতে গেলো | আনাম একটা রেস্টুরেন্টে বসে কপি খাচ্ছে |
আনাম ; নিশু তুই খাবি?
নিশু ; না ভাইয়া | ভাইয়া, ভাবি কোথায় গেছে তুমি জানো? সারা বাড়িতে ভাবি নেই |
আনাম ; মনে হয় ব্যায়াম করতে বের হয়েছে,
নিশু ; কোথায়?
আনাম ; ঐ মেঠোপথ খোলা মাঠে হা হা হা |
নিশু আনামের হাসি দেখে ভয় পেল | সে উঠে একটা রিকশা নিয়ে খোলা মাঠের দিকে চলতে লাগলো এবং এদিক সেদিক ভাবিকে খুঁজতে লাগলো | হঠাৎ দেখলো ভাবি দৌড়াচ্ছে,পেছনে তিনটি ছেলে ও –|
রিকশা তাড়াতাড়ি চলায় সামনের চাকায় ধাক্কা লেগে রাবেয়া পড়ে যায় | অমনি একজন চুরি বের করে রাবেয়াকে মারতে চাইলে নিশু দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করতেই ওরা পালিয়ে যায় | রাবেয়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে |
নিশু বাসায় নিয়ে রাবেয়াকে শুইয়ে রাখে, ডাক্তারের কাছে কল দেয় |
ডাক্তার এসে চেকআপ করে বলল, উনি কি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না | এখন থেকে ঠিকমত খেতে হবে, উনি মা হতে চলেছেন |
জাহেদা ; কি বলছেন ডাক্তার সাহেব ? শরীর তো কমে নাই আর আপনি বলছেন দূর্বল!
ডাক্তার ; ঠিকমতো না খেলে আরো শরীর খারাপ করবে, আমি আসি |
নিশু রাগান্বিত হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বলল, মা তুমি তোমার ছেলেকে বুঝাও, আজ যা করেছে ভাইয়া একটা জানোয়ারে ও এসব করবে কি না সন্দেহ!
আমি আজ চলে যাব | তোমার জামাইর খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে | তুমি খেয়াল রেখো ভাবির প্রতি | তুমি ভাইকে উৎসাহ দিওনা অন্যায় করতে | প্লিজ মা –+
চলবে —
শেষের অংশ
আনাম ঘরে এসে রাবেয়াকে শুয়ে থাকতে দেখে আরো রাগান্বিত হলো | রাবেয়ার চোখের নীচে কালি জমেছে, গায়ের রং কালো হয়ে গেছে, ঠিকমত দাঁড়াতে পারেনা মাথা ঘোরানোর জন্য |এই কয়দিনে রাবেয়ার শরীর যতটানা দূর্বল হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে মন |
জাহেদা বেগম আনামকে ডেকে নিয়ে সব বললেন | আনাম রাবেয়ার কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলল,আমি কি তোমার কাছে বাচ্চা চেয়েছি? এক্ষুণি চলো আমার সাথে ডক্টরের কাছে, ওটা এবাউট করতে |
রাবেয়া ; না, আমি যাবো না | মা আপনার ছেলেকে বুঝান, ওর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে |
আনাম ; কি বললি? আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে! শোন,যদি আমার সাথে ডক্টরের কাছে না যাস তাহলে তোর শরীরের মাংস চুরি দিয়ে কেটে স্লিম করবো আর আজ থেকে তোর খাওয়া একেবারে বন্ধ | শুধু পানি খাবি |
এই বলে আনাম এখান থেকে এসে রান্না ঘরের চাল সবজি মাছ মাংস সব তালা দিয়ে রাখে |
জাহেদা ; আরে আনাম, তুই এসব কি করছিস? আমাকে কি তুই না খাইয়ে মারতে চাস?
আনাম ; না মা, তোমার জন্য রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনবো |
আনাম অফিসে চলে যায় | রাবেয়া উঠে দাঁড়াতে পারছেনা | শুধু মাথা ঘোরে পড়ে যাচ্ছে, রান্না ঘরে গিয়ে দেখে কিচ্ছু নেই রান্না করার |
রাবেয়া শাশুড়ীর কাছে গিয়ে একটু খাবার চাইলো | মা, আমাকে একটু খাবার দিন |
জাহেদা ; আমি কি জানি? আর এত মোটা শরীরে খাবার লাগে না কি?
রাবেয়া কাঁদতে কাঁদতে খাটে ঘুমিয়ে পড়লো | হঠাৎ করে আনাম ঘরে এসে তাকে ডেকে বলল, শাড়ি নয় এই ড্রেসটা পরে আমার সাথে চল |
রাবেয়া ; দেখি তো ড্রেস, একি এত ছোট ড্রেস আমি পরবো কিভাবে? এটা আমার গায়ে হবে না | তাছাড়া আমার শরীরটা ভালো নয় |
আনাম ; কি বললি? তোর শরীর ভালো নয় আর ড্রেস হবে না! দাঁড়া তোর ড্রেস গায়ে হতেই হবে |
এই বলে আনাম একটা চুরি বের করে রাবেয়ার দিকে এগুতেই রাবেয়া দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে তার বান্ধবীকে একটা কল দিয়ে বলে আমাকে বাঁচা | তাড়াতাড়ি পুলিশ নিয়ে আয় |
আনাম দরজা ধাক্কা দিতে দিতেই ছিটকিনি খুলে যায় |
রাবেয়া প্রাণ বাঁচানোর জন্য শাশুড়ির ঘরে গিয়ে শাশুড়িকে ধরে উনার পেছনে লুকায় |
জাহেদা ছেলের হাতে চাকু দেখে ভয় পায় ও বলে আনাম তোর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে | এটা করিসনা, চাকু রেখে দে |
আনাম ; তুমি সর মা, ওর চর্বি কমাবো আমি |
রাবেয়া শাশুড়ীকে সামনে রেখে এদিকে সেদিকে যায় |
এক সময় রাবেয়া শাশুড়ীর ঘরের ফুলদানি দিয়ে আনামের ঘাড়ে আঘাত করে | এতে আনাম একটু শান্ত হয় |
এমন সময় রাবেয়ার বান্ধবী সুমা পুলিশ নিয়ে হাজির হলো |
রাবেয়া পুলিশকে সব খুলে বলল | ও আনামকে দাঁড় করিয়ে বলল, আমার গুণের তুমি মুল্য দিলেনা | অন্যদের কথায় তুমি আমাকে অনেক অত্যাচার করেছো | অনেক আগেই পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত ছিল | যাইনি তোমার সম্মান নষ্ট হবে বলে | আর আমার মোটা শরীর নিয়েই আমি ভালো আছি ও ভালো থাকতে চাই | আল্লাহ তোমাদের হেদায়েত করুক |
আর মা, তুমি এই বয়সে জেলে যাবে তোমার কর্ম গুণে | কোনদিন ছেলেকে অন্যায় কাজে নিষেধ করনি!
পুলিশ সাহেব , ওনাদের নিয়ে থানায় চলে যাও |
নিশু এই খবর শুনে জেল হাজতে গিয়ে মা, ভাইকে দেখে বলল,
যেমন কর্ম তেমন ফল |
থাকো তোমরা ওখানো –
যার জায়গা যেখানে |
নিশু রাবেয়াকে ডক্তরের কাছে নিয়ে ট্রিটমেন্ট
করালো |
- সমাপ্ত।
————–