ডা.আরিফুর রহমানঃ নেলসন মেন্ডেলা বলেছেন, আমি ২০ বছর জেলে থাকতে থাকতে একদিন রাতে ইচ্ছে হচ্ছিল বর্ণবাদী সরকারের সব কথা মেনে নিয়ে মুচলেকা দিয়ে আপোষ করে বেরিয়ে আসি।
এসময় হটাৎ তখন ইমাম হুসাইন ও কারবালার সব ঘটনা মনে এলো। আমি মনে প্রচন্ড শক্তি পেয়ে গেলাম। অধিকার ও মুক্তির আন্দোলনে আমি দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম এবং আরাধ্য মুক্তি মিলে গেলো।
ষাট হিজরীতে পিতা মুয়াবিয়া (রা) তার পুত্র ইয়াজিদকে খলিফা ঘোষণা করা ইসলামের মর্মের চেয়ে রাজতান্ত্রিক ধারায় বেশি প্রভাবিত ছিলো। হজরত হুসাইন(রা) ইয়াজিদের বায়াত নেননি শুনে ইরাকের লোকেরা চিঠি পাঠিয়ে জানালো তারা ইয়াজিদ নয় হুসাইন(রা)কে খলিফা হিসাবে চায়। তাই হুসাইন(রা)র চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকেল কুফায় যেয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চিঠি লিখে হুসাইনকে (রা) জানান যে, কুফাবাসীদের কথা বাস্তব আপনি কূফায় চলে আসুন।
তারপর মুসলিম বিন আকেল বসরার গভর্ণর উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করেন চার হাজার সমর্থক নিয়ে। গভর্নর ঘেরাও অন্দোলনরত জনগণকে ইয়াজিদের সেনাবাহিনীর শাস্তির ভয় দেখালে বিক্ষোভকারীরা সবাই সরে পড়ে সন্ধ্যার আগেই। সেইদিনই উবায়দুল্লাহকে গ্রেফতার করে ক্রসফায়ার দেয়া হয়।
মৃত্যুর আগে তিনি হুসাইনের (রা)র কাছে চিঠি পাঠান, “ভাই হুসাইন, পরিবার পরিজন নিয়ে ফেরত যাও। কুফার লোকজন ধোকা দিচ্ছে, তারা তোমাকে মিথ্যা সমর্থন দেখিয়েছে, আমার সাথেও তারা সত্য বলেনি।”
যাত্ৰাপথে সেই চিঠি হুসাইন(রা) পেলেন, তিনি কুফার পথ ছেড়ে ইয়াজিদের সাথে দেখা করার জন্যে সিরিয়ার দিকে যেতে থাকলেন।
কিন্তু বসরার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের হুকুমে ইয়াজিদের সৈন্য আমর, সীমার বিন জুল শাওশান, হুসাইন বিন তামিম কারবালাতে হুসাইনের (রা) পরিবার ও ২০০ সহযাত্রীদের অবরুদ্ধ করলো। রক্তপাত ও খুনাখুনি বন্ধের উদ্দেশে হজরত হোসাইন (রা) তিনটি প্রস্তাব দেন।
১) হয় তাঁকে মদিনায় ফিরে যেতে দেওয়া হোক।
২) না হয় তাঁকেতুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেওয়া হোক। সেখানে থেকে তিনি জিহাদ করবেন এবং খেলাফতের বর্ডার গার্ড থাকবেন।
৩)তাও না হলে ইয়াজিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য তাঁকে দামেস্কে পাঠানো হোক।
কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেন।
হজরত হোসাইন (রা) তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করে ইয়াজিদ বাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘আমি যুদ্ধ করতে আসিনি, এমনকি ক্ষমতা দখল আমার উদ্দেশ্য নয়। খিলাফতের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার আমার কাম্য।’
কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের চার হাজার সৈন্যের বাহিনী হুসাইনের কোন কথাই শোনেনি, অন্যদের অনুরোধও শোনেনি। তারা হজরত হোসাইন (রা)এর কাফেলাকে পানিতে মারার জন্য ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। হজরত হোসাইন (রা)এর শিবিরে পানির হাহাকার শুরু হয়।
ইয়াজিদ বাহিনী ১০ মুহাররম এই আশুরার দিনে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একটি অসম ও অন্যায় যুদ্ধে ৭০ থেকে ৭২ জন শহীদ হন। হজরত হোসাইন (রা)এর ছিন্ন মস্তক বর্শা ফলকে বিদ্ধ করে দামেস্কে পাঠানো হয়। ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে ছিন্ন মস্তক প্রত্যর্পণ করলে কারবালা প্রান্তরে তাকে কবরস্থ করা হয়।
নবী(স)এর কলিজার টুকরা নাতির এই শহীদি মৃত্যু আল্লাহ নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। নিচের ঘটনাটি পড়লে এটি পরিষ্কার হবে।
উম্মে ফজল বিনতে হারেস (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি একদিন নবী করিম (সা) এর ঘরে গিয়ে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একটি খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। রাসূল (সা) বলেন, স্বপ্নটি কী?
তিনি বললেন, আমি দেখেছি আপনার দেহ থেকে একটি গোশতের টুকরা আলাদা হয়ে আমার কাছে এসে পড়েছে।
রাসূল (সা) বলেন, ভালো স্বপ্ন দেখেছো। আমার কন্যা ফাতেমা ছেলে সন্তান জন্ম দেবে। ওই সন্তান তোমার কাছে লালিত পালিত হবে।
রাসূল (সা)এর ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী কিছু দিন পর ফাতেমা (রা)এর ঘরে হুসাইন (রা) জন্মগ্রহণ করেন। উম্মে ফজলের কাছে লালন পালনের জন্য দেয়া হলো। কিছু দিন পর উম্মে ফজল তাকে নিয়ে আসেন রাসূল (সা)এর কাছে।
রাসূল (সা) তাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। উম্মে ফজল বলেন, কী হয়েছে আপনার ইয়া রাসূলাল্লাহ!
রাসূল (সা) বলেন, এই মাত্র জিবরাইল (আ) এসে আমাকে সংবাদ দিয়ে গেছেন যে, আমার এই সন্তানকে আমার উম্মতেরা হত্যা করবে। (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৫১১)
ইতিহাস অনুযায়ী হজরত হোসাইন (রা)কে কারবালা প্রান্তরে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে করুণ পন্থায় তাদের প্রত্যেকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
তাই আশুরার দিনে আমরা কারবালার এই মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণ করি। শিয়া সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব পন্থায় এই দিনটিকে স্মরণ করে।
আশুরার আরেকটি অর্থ এসেছে আবহমানকাল ধরে চলা ঐতিহ্য থেকে; ইসলামের আবির্ভাবেরও বহু আগ থেকে।
সূরা আত-তাওবাহ ৯: ৩৬ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
নিশ্চয় আল্লাহর আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে বিধান ও গননায় মাস বারটি। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস।
ওই চারটি মাস কী কী?
হজরত আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা) ইরশাদ করেন, এক বছরে ১২ মাস। এর মধ্যে চার মাস বিশেষ তাৎপর্যের অধিকারী। এর মধ্যে তিন মাস ধারাবাহিকভাবে অর্থাৎ জিলক্বাদ, জিলহজ ও মহররম, এবং চতুর্থ মাস মুজর গোত্রের রজব মাস। (বুখারি-৪৬৬২, মুসলিম-১৬৭৯)।
রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর ফরজ ছিল। পরবর্তী সময়ে ওই বিধান রহিত হয়ে তা নফলে পরিণত হয়।
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা)কে রোজা রাখার জন্য এত অধিক আগ্রহী হতে দেখিনি যত দেখেছি এই আশুরার দিন এবং রমজান মাসের রোজার প্রতি। বোখারি:১৮৬৭
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। সহিহ মুসলিম:১৯৭৬