দিলীপ রায়ঃ সিলেট স্টেশন থেকে রাত সাড়ে নয়টায় ছাড়ল ট্রেন। লোকে লোকারণ্য। টিকেট ছাড়া এত মানুষ ট্রেন চড়ে তা জানা ছিল না। সিটের কাছাকাছি পৌঁছতে বেশ বেগ পেতে হলো। শোভন চেয়ার। আমার সিটটা বাম সারির ডান পাশে। ওখানে একটা যুবক বসা। যুবকটির চেহারা বদ। উশকুখুশকু চুল। গতরে রঙছটা একটা টিশার্ট, জিন্সের প্যান্টটা দুই হাঁটু বরাবর কিঞ্চিত ডিজাইন করে ছেঁড়া। কানে হেডফোন। পায়ে দৃষ্টিকটু কালারের ক্যাডস। সব মিলিয়ে জাস্ট অসহ্য।
আপনার টিকেট নম্বর কত? জিজ্ঞেস করলাম। ছেলেটি গা করল না। আবার জিজ্ঞেস করলাম। তখন ছেলেটি পাল্টা আমার সিট নম্বর জানতে চাইল। বললাম। আমার নির্ধারিত সিটটির ঠিক বাম পাশের সিটটি খালি। এটি দেখিয়ে দিয়ে যুবকটি বলল, ‘ওটাতে বসে যান। ওটা আমার সিট।’
কথা বাড়ানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না। ব্যাগটি মাথার উপর বক্সে রেখে বসে পড়লাম। শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে ট্রেনটি থামল। যুবকটি উঠে গেল। ট্রেনটি ছেড়ে দেবার সময় হলো কিন্তু যুবটির আসার নাম নেই। ভাবলাম ওর গন্তব্যই হয়তো শেষ। একসময় ট্রেনটি ছেড়ে দিল। ঠিক তখনি একজন প্রায় প্রৌঢ় পড়িমরি করে আমার পাশে যুবকটি যে সিটটিতে বসেছিল সেটিতে এসে বসলেন। আমার তখন খানিকটা তন্দ্রা ভাব এসেছে। পরিশ্রান্ত প্রৌঢ় লোকটিও চোখ বুজলেন এবং একটু পর ট্রেনের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হালকা নাক ডাকা শুরু করলেন।
চলমান ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে ধারাবাহিকভাবে বিবিধ পশরা নিয়ে হকাররা আসছে। আসছে চাওলা, চানাচুরওলা, গানওলা, পানওলা, পানিওলা, বৃহন্নলা। চেঁচামেচি, হইচই। সিটের অতিরিক্ত যাত্রী। কেউ কেউ আবার বাদুড়ঝোলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর খেয়াল করলাম প্রৌঢ় লোকটির পাশ ঘেষে সেই যুবকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক তখনি ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়ে থামল এবং প্রৌঢ় লোকটি চেঁচিয়ে উঠলেন। ঘটনাটি বুঝার জন্য মনোযোগ সহকারে থাকালাম।
ট্রেনের ঝাঁকুনির চোটে যুবকটির একটা কনুই প্রৌঢ় লোকটির মাথার উপর ঠেকেছে। এ কারণে প্রৌঢ় ধমকের সুরে যুবকটিকে শাসাতে থাকেন এবং সরে যেতে বলেন। বিড় বিড় করে ট্রেন কর্তৃপক্ষের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে থাকেন।
যুবকটি ততক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে বলে, ‘চাচা, যে সিটটিতে বসে আছেন এটি আমার। আপনি মুরুব্বি মানুষ এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলেন তাই ডাকি নি। আপনি কি টিকেট কেটেছেন?’ প্রৌঢ়টি প্যাকেটের ভেতর খুঁজেটুজে একটা টিকেট বের করলেন। যেটি আসলে স্ট্যান্ডিং টিকেট। এটি জানার পর প্রৌঢ়টি হায় হায় করে উঠলেন।
বললেন, ‘আমার টিকেটটা তো একজন পুলিশ কাইটা দিল। আর এই বগিতে তুইলা দিয়া কইল এখানেই আপনার সিট। বসেন গিয়া।’ তখন শেষ প্রহর। ক্রমানুসারে ক্ষয়ে আসছে সময়।
লেখকঃ প্রভাষক, গণিত, মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, সিলেট।