গোলাম শফিউল আলম মাহিন
রোজা শব্দটি ফার্সি। আরবি শব্দ সিয়াম এবং সওম। বাংলা অর্থ বিরত থাকা।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় রোজা মানে হলো সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার এবং যাবতীয় পাপাচার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা।
মাহে রামদ্বানে পুরো মাস রোজা রাখা উম্মতে মোহাম্মদীর ফরজ করা হয়েছে। ২য় হিজরীর শাবান মাসে মদীনায় রোজা ফরজ সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয়। মহান আল্লাহ সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে ইরশাদ করেন,
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো যেভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা সংযমী হও”। একই সূরার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ আবার বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসকে পায় সে যেন রোজা রাখে”।
এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে আল্লাহ এই মাসে প্রাপ্ত বয়স্ক সকলের উপর রোজা ফরজ করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ এই ফরজ কাজটি যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে পালন করেন। তবে বর্তমান সমাজে দেখা যাচ্ছে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের ছোট বয়স থেকে রোজা রাখার শিক্ষা থেকে বিরত রাখছেন। অতি আদর সোহাগে ছেলে-মেয়েরা চাইলেও তাদেরকে রোজা রাখতে বাঁধা প্রদান করেছেন। অথচ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাচ্চাদেরকে রোজা রাখার উৎসাহ দিতে বলেছেন আমাদেরকে।
রুবাইবিনতে মুআওয়েয ইবনে আফরা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার সকালে মদিনার আশেপাশে আনসারদের এলাকায় (এই ঘোষণা) পাঠালেন : ‘যে ব্যক্তি রোযা অবস্থায় সকাল শুরু করেছে, সে যেন তার রোযা পালন সম্পন্ন করে। আর যে ব্যক্তি বে-রোযদার হিসেবে সকাল করেছে সে যেন বাকি দিনটুকু রোযা পালন করে।’ এরপর থেকে আমরা আশুরারদিনরোযা পালন করতাম এবং আমাদের ছোট শিশুদেরকেও (ইনশাআল্লাহ্) রোযা রাখাতাম। আমরা (তাদের নিয়ে) মসজিদে যেতাম এবং তাদের জন্য উল দিয়ে খেলনা তৈরী করে রাখতাম।তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে সেই খেলনা দিয়ে ইফতারের সময় পর্যন্ত সান্ত্বনা দিয়ে রাখতাম। [হাদিসটিবর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী (নং ১৯৬০) ও মুসলিম (নং ১১৩৬)]
এমনকি এক হাদিসে এসেছে হজরত উমর রা. এক মদ্যপ ব্যক্তিকে বলেছেন, তোমার জন্য আফসোস! আমাদের ছোট শিশুরা পর্যন্ত রোযাদার!” এই বলে তাকে প্রহার করতে শুরু করলেন।
ছোট বাচ্চাদের অল্প বয়স থেকে যদি বাবা-মার সঙ্গে একটি দুটি করে রোজা রাখার অভ্যাস করানো হয়, তাহলে বালেগ হওয়ার পর তাদের আর রোজা রাখতে কোনো সমস্যা পোহাতে হবেনা। ওরা নির্দ্বিধায় রোজা রাখতে পারবে। এমনকি রোজার দ্বারা অনেক খারাপ কাজ থেকেও বিরত থেকে সর্বদা পাক এবং পবিত্র থাকতে পারবে। রোজা রেখে তাদেরকে টিভি দেখতে না দিয়ে নামাজের জরুরি মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা দেওয়ার অভ্যাস গড়ুন। তাদেরকে নামাজ পড়ার শিক্ষা দিন। পবিত্র কোরআন মজিদ তেলাওয়াতের শিক্ষা দিন। মাহে রমাদ্বান উপলক্ষে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পবিত্র কোরআন মজিদ বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি হয়। সেখানে ঘুমের চিন্তা বাদ দিয়ে আপনার সন্তানকে প্রেরণ করুন। আপনার কুরআন তেলাওয়াতে যদি ভুল থেকে থাকে তাহলে আপনিও তার সঙ্গে কোরআন শিক্ষা কাজক্রমে যুক্ত হোন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে কোরআন শিক্ষা গ্রহন করে এবং অপরকে তা শেখায়”। (আবু দাউদ : ১৪৫২)
কোরআন তেলাওয়াতে যদি ভুল হয়, তাহলে সওয়াবের পরিবর্তে আপনার সঙ্গী হবে অপ্রত্যাশিত গুনাহ। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, “কোরআনের এমন কিছু পাঠক আছে, যাদেরকে কোরআন লানত করে”।
তাই আসুন আপনার সন্তানকে দীক্ষিত করুন কোরআনের শিক্ষায়। তাকে শিক্ষা দিন রোজা রাখার। সৎ পথে চলার উপদেশ দিন। এই বয়স থেকে যদি রোজার শিক্ষা না দিয়ে তৈরি করেন, তাহলে ভবিষ্যতে যখন বালেগ হবে, তখন রোজা পালন করতে অবহেলা এবং অপারগতা দেখা যাবে। সাহাবি সৈয়্যদুনা হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন – রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের একদিনের রোজা শরিয়তের অনুমতি ও রোগাক্রান্ত হওয়া ছাড়া ভেঙ্গেছে (রাখেনি) তাহলে সমগ্র মহাকাল যাবত রোজা রাখলেও সেটার কাযা আদায় হবে না।
(সহিহ বুখারী, ১ম খণ্ড, হাদীস-১৯৩৪)
অহেতুক রোজা ভঙ্গকারীর উপর রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিরস্কার করেছেন। সাহাবি সৈয়্যদুনা হযরত জাবির (রাদি.) ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়েছে আর সেটার রোজা রাখেনি, সেই ব্যক্তি হতভাগা। যে ব্যক্তি আপন পিতামাতাকে কিংবা উভয়ের যে কোনো একজনকে পেয়েছে কিন্তু তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেনি, আর যার নিকট আমার নাম উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু সে আমার উপর দরুদ শরীফ পাঠ করেনি, সেও হতভাগা।
(মাজমাউয যাওয়ায়িদ, ৩য় খণ্ড, ৩৪০ পৃষ্ঠা)
তাই আপনার সন্তানকে রোজা পালনে উদ্যুদ্ধ করুন। নয়তো এ গুনাহর অংশীদারিত্ব আপনার কপালেও পড়বে। এই সকল গুনাহ থেকে আল্লাহ যেন আমাদেরকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুক এবং পরিপূর্ণ রোজা রাখার সুযোগ দান করুক। আমিন।
লেখকঃ
গোলাম শফিউল আলম মাহিন
শিক্ষার্থী, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।