১৯৯৪ সালে আকিলপুর গ্রামের মুক্তার আলী সিলেট হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার থেকে সুমন বিপ্লব নামের এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসেন ঘরের কাজের জন্য। আসার পর থেকেই মুক্তার আলীর ঘরের কাজ করতে লাগলো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষা নিয়ে মানুষের সাথে আলোচনা করতে লাগলো এবং মাঝে মাঝে কবিতা ও ছোট ছোট গল্প লেখতো। এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে রত্নগর্ভা এওয়ার্ড প্রাপ্ত নারী ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরী সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগলো। আমি ঐ বছর পরীক্ষার্থী। আমি তখনও জানিনা ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরীর স্বামীর বাড়ি আকিলপুরে। সুমন বিপ্লবই আমাকে বললো উনার স্বামীর বাড়ি আকিলপুরে। তারপর সুমন বিপ্লব আমাকে বললো তার নামে কিছু একটা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সামান্য সহযোগিতা করেছি। ঐ বছরই আকিলপুরে গ্রামে একটি পাঠাগার গড়ে তুললো।
যার নাম ছিল প্রতিভা পাঠাগার। এই পাঠাগারেই বিনা পারিশ্রমিকে ছোট ছোট বাচ্চাদের শিক্ষা দিতে শুরু করলো। এখানে উল্লেখ থাকা আবশ্যক যে পাঠাগার করলেও ঐ মুক্তার আলীর কাজ ঠিকই চালিয়ে গেল। ১৯৯৯ সালের পর ঢাকায় গিয়ে ড. মঞ্জুশ্রী ও উনার দুই ছেলে ড. অরূপ রতন চৌধুরী ও ডা. শুভাগত চৌধুরী এবং এক মেয়ে মধুশ্রী ভদ্রের সাথে দেখা করলো। শুরু হল ড. মঞ্জুশ্রী বিশ্ব একাডেমির কাজ। সুমন বিপ্লব তার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো। পাঠাগারের পাশাপাশি লেখালেখিও করতে লাগলো। সব চেয়ে অবাক করার বিষয় যে ব্যক্তির এক টাকা মূলধন নেই ঐ ব্যক্তি নিজের ও অন্যের লেখাসহ মোট ৯৭ টি বই এ যাবৎ প্রকাশনা করেছে। তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে, এতগুলি বই প্রকাশনা করতে টাকা পেল কোথায়? সব টাকাই বিভিন্ন এলাকার লোকের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে নিয়েছে। সুমন বিপ্লবকে দেখে অবাক হবেন যে, এই লোক কিভাবে এতগুলি বই প্রকাশনা করলো। সে যাকে পায় তাকেই লেখালেখি করার জন্য উৎসাহ দেয়। তার উৎসাহে এলাকার অনেক লোক লেখালেখিতে এগিয়ে এলো। প্রথমে তাকে সবাই সন্দেহের চোখে দেখতো। কোথাকার সুমন বিপ্লব কেউ চিনে না, জানে না, কোনদিন ছোট ছোট বাচ্চাগুলো নিয়ে না আবার পালিয়ে যায় কারণ তার বাড়ি যে খুলনায়।
২০০২ সাল, এত দিনে সুমন বিপ্লব আকিলপুর গ্রামের হিন্দু মুসলিম সবার প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়েছে। এরই সূত্র ধরে তার পরিচিত চট্টগ্রাম শহরে বাড়ি, অনেক দিন যাবৎ সিলেট শহরে বসবাস করে। সিলেটের সবুজ বিপণী মার্কেটে জ্যোতিষীর ব্যবসা করে সবুজ আচার্য্য নামের এক ব্যক্তি আকিলপুর গ্রামে নিয়ে এলো। এখানে উল্লেখ্য যে, একাডেমির অনুষ্ঠানের অন্যান্য অথিতির সাথে সবুজ সাহেব এসেছিলেন। সুমন বিপ্লব সবুজ সাহেবের বাসায় কাজ করতে সিলেট চলে যায়। ওর বাসায় কাপড়, থালা-বাসন ধোয়া থেকে সব কাজ তাকে করতে হতো। এইভাবে সবুজের বাসায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে থাকে। এই কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে তার লেখালেখিও চালিয়ে যেতে থাকলো। কারণ সেভাবে লেখালেখির মাধ্যমেই একদিন তার সফলতা আসবে। একদিন সুমন বিপ্লব সিলেট শহরে যাওয়ার ফলে আকিলপুরে ড. মঞ্জুশ্রী একাডেমি বন্ধ অবস্থায় পড়ে রইলো। এইভাবে দিনের পর দিন রাতের পর রাত মাসের পর মাস যেতে লাগলো। প্রায় তিন বৎসর পর সবুজ তার স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে গেল, সুমন বিপ্লব আবার আকিলপুরে চলে এলো। এবার এসে সে সাবেক চেয়ারম্যান মো. লালা মিয়ার বাড়িতে উঠলো এবং তাঁর একাডেমি ও পাঠাগার নিয়ে গবেষণা শুরু করলো। আমি ভাবতে অবাক হই এই প্রতিকূলতার মাঝেও কিভাবে একজন মানুষ লেখালেখি করে। কিভাবে এই দেশ ও জাতিকে শিক্ষিত করা যায় তা ভাবে। কিভাবে পাঠাগারটিকে বিশ্বমানের করা যায় সেই চিন্তা নিয়েই মগ্ন থাকে। সুমন বিপ্লব আকিলপুর গ্রামে একটি কিন্ডারগার্ডেনও খুলে ছিল। যার নাম হচ্ছে ‘হযরত শাহজালাল (রঃ) শিশু কানন’। যেটির পরিচালনা করেছেন উনি নিজেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, এই শিশু কাননের নির্দিষ্ট কোন ঘর ছিল না। আজ একজনের ঘরে কাল অন্যজনে উঠোনে এই রকমভাবে শিশু কাননে শিক্ষাদান চলছিল। শিশু কাননে আরো শিক্ষক ছিল তিন জন। এই তিনজনকে সামান্য পরিমাণ সম্মানী দেওয়া হত। যে টাকাগুলো বাচ্চাদের গার্জিয়ানদের কাছ থেকে পাওয়া যেত। এবং যে যা অনুদান দেয় তা থেকেই শিশু কাননে শিক্ষাদান চলছিল। শুধু ব্যতিক্রম একটাই সুমন বিপ্লব কোন একটি টাকাও নেয় নি। যেটুকু সময় অবসর পেলেই তখন দেখা যায় শুধু বাচ্চাদের শিক্ষা দিচ্ছেন। একাডেমির কোন ঘর না থাকায় কার্যক্রম কোন রকম চলছে। লেখালেখি করার সুবাধে পোস্ট অফিস মারফত বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠাতে হয়। এমনকি আজ প্রায় ২০ বছরের মধ্যে একটি দিনের জন্য জন্মস্থান খুলনায় যাননি, শুধু একটাই স্বপ্ন এই জাতিকে কিভাবে শিক্ষিত করবে। আজ একাডেমির জন্য নেই নির্দিষ্ট ঘর। ১৯ বছরে প্রায় ৭/৮ বার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে একাডেমির।
কে এই সুমন বিপ্লব আসুন তার সম্পর্কে জেনে নেই। ফারুক ওরফে সুমন বিপ্লব এর জন্ম খুলনার শাহপুর ফকির পরিবারে ১৯৬৭ সালের ১ নভাম্বর। পিতা দক্ষিণ বাংলার খুলনা জেলার কৃষক নেতা মরহুম আলী আকবর ফকির। মাতা- বেগম ফাতেমা লুৎফা।
শিক্ষা জীবনঃ ১৯৭৩ সালে শাহপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শুরু। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণি শাহপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ৯ম শ্রেণিতে কয়েকমাস পড়ার পর ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সুভাস নগরে ভবঘুরে জীবন শুরু করেন। দুই মাস পরেই তার বাবা অনেক অনুসন্ধানের পর তাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। ১৯৮৪ সালে দশম শ্রেণিতে পুনরায় ভর্তি হন। ১৯৮৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ৭ টি বিষয়ের ফেল করে ছাত্র জীবনের সমাপ্তি টানেন। এ বছরই অনেক বুঝিয়েও তাকে ছাত্র জীবনের গন্ডিবদ্ধ লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় নি। শুরু হয় তার লেখালেখির জীবন। অল্পদিনের ভিতরেই নিজের গ্রামে সাহিত্যমনা কয়েকজনকে নিয়ে জাগরণ পাঠাগার ও ভদ্রা সাহিত্য গোষ্ঠী গড়ে তুলে। তার ভবঘুরে মন আবার পাড়ি জমায় ভারতে। যাওয়ার পথে সীমান্ত এলাকায় পার হওয়ার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে চব্বিশ পরগণা জেলার বসির হাট সাব জেলে আবদ্ধ হয়। দুই মাস জেলে থাকার পর তার ছোট মামার মাধ্যমে দেশে ফিরে আসে। ১৯৮৬ সালে খালিশপুরে মামার বাসায় থাকা অবস্থায় কথাশিল্পী বেদুঈন সামাদ ও সাংবাদিক মোহন হাসানের সাথে তার পরিচয় হয়। তার মামী হাসিনা জোহরও একজন কবি। ১৯৮৭ সালে ঢাকায় যান। ঢাকা থেকে এভাবেই ভবঘুরে মনটাকে নিয়ে আসেন সিলেটের হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজারে।
আজ ড. মঞ্জুশ্রী এই দুনিয়াতে নেই। কিন্তু জীবিত অবস্থায় শুনে গেছেন উনার স্বামীর বাড়িতে নিজের নামে একটি একাডেমি হয়েছে। যে কিনা সুদূর খুলনা থেকে এসে সিলেটের আকিলপুর গ্রামে তার নামে একাডেমি করেছে। যে আবার তার জীবনের জন্য কিছুই করেনি এবং বাকী জীবনেও কিছু প্রয়োজন মনে করে না। শুধু প্রয়োজন মনে করে এই জাতিকে কিভাবে শিক্ষিত করা যায়। তার বয়স আজ প্রায় ৪৬ বছর। এই সব বিবেচনায় আমার মনে হয়েছে সুমন বিপ্লব সাদা মনের মানুষ। তাই আপনাদেরকে অনুরোধ করবো আপনারে এগিয়া আসুন। সুমন বিপ্লবের মতো মানুষ আমাদের সমাজের জন্য, আমাদের দেশের জন্য, সর্বোপরি আমাদের সবার জন্য দরকারি। আমরা সবাই তাকে অনুসরণ করতে পারি। তার শিশু কাননের জন্য একটি ঘর নেই, পাঠাগারের জন্য একটি ঘর নেই, একাডেমির জন্য ঘর নেই, আপনারা সবাই এগিয়ে আসলে সুমন বিপ্লবের আশা পূর্ণ হবে। তার ইচ্ছা সে এই গ্রামে হাইস্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা করবে।
মো. মঈন উদ্দিন
আকিলপুর, বিশ্বনাথ, সিলেট ।