কামরুল হাসান কাজল, বানিয়াচংঃ- স্বাধীনতার ৫০ বছর পর হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দিতে শহীদদের স্মরণে ৩৩ লক্ষ ২৯ হাজার টাকা ব্যয়ে স্মৃতিসৌধটি গত ১৮ আগষ্ট বুধবার দুপুরে স্হানীয় এমপি এডভোকেট আলহাজ্ব আব্দুল মজিদ খান উদ্বোধন করেন।
জানা যায় জেলার বানিয়াচং উপজেলার উত্তর দিকে হাওরাঞ্চলে অবস্থিত কাগাপাশা ইউপির একটি গ্রাম মাকালকান্দি।এ গ্রামে ১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট নির্বিচারে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী, পুরুষ, শিশু সহ প্রায় ১২৫ জনকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। এরপর থেকেই প্রতিবছরই এ দিনটি আসলেই স্বরণ হয়। দিবসটিতে উপজেলা প্রশাসনসহ সর্বস্তরের জনগণ শহীদদের স্বরণে শহীদ মিনারে ফুলেল শুভেচছা জানায়।
১৯৭১ সালের পাকবাহিনী রাজাকারদের সঙ্গে বৈঠক করলে খবরটি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে আজমিরীগঞ্জের দাস পার্টির প্রধান শহীদ জগৎজ্যোতি দাস, ও বানিয়াচংয়ের রমেশ চন্দ্র পান্ডের সমন্বয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গেরিলা বাহিনী প্রতিরোধের দূর্গ গড়ে তোলেন। তারা উপজেলার প্রায় সবকটি এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করে পরিস্থিতি পাক হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনেন।১৫ ই আগষ্ট ১৯৭১ সালে বানিয়াচং রাজবাড়ীতে পাকিস্তানী মেজর দুররানী খানের নেতৃত্ব একদল পাক সৈনিক কিভাবে হত্যাকান্ড পরিচালনা করবে তা নিয়ে আবারো ২য় বারের মতো শান্তি কমিটির সাথে বৈঠকে মিলিত হয়।
পরে ১৮ ই আগষ্ট মাকালকান্দি গ্রামে গণহত্যার পরিকল্পনা চুড়ান্ত করা হয়।সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর দুররানীর নেতৃত্বে ১৮ ই আগস্ট ভোরে পাকহানাদারদের ১৬টি নৌকা বোঝাই সৈনিক ও রাজাকার কমান্ডার আব্দুর রহমানের নেতৃত্ব আরো চারটি নৌকায় রাজাকার বাহিনী বৃষ্টির মধ্যেই মাকালকান্দি গ্রামে রওয়ানা দেয়। সকাল ৭টার মধ্যে রাজাকার ও পাক হানাদাররা ঐ গ্রামে পৌঁছে । সকাল বেলা গ্রামের চণ্ডি মন্দিরে মনসা ও চণ্ডি পূজার প্রস্তুতি চলছিল।এ সময় পাকহানাদার ও রাজাকার বাহিনীরা মোট ২০টি নৌকার বহরে এসে গ্রামে হামলা চালায়।
এ সময় পূজারত নারী-পুরুষদের চণ্ডি মন্দিরের সামনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মূহুর্তের মধ্যে রক্তে লাল হয় পুজোর ফুল। এতে একই পরিবারের ১১ জন নারী, পুরুষ, শিশুসহ মোট ১২৫ জন প্রাণ হারান।হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাক বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় খাদ্য ভাণ্ডারে সমৃদ্ধশালী গ্রাম মাকালকান্দি থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণ অলংকারসহ সমস্ত সম্পদ লুটে নেয়। যাবার সময় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ঘরবাড়ি। নির্মম হত্যাযজ্ঞ থেকে চারদিনের শিশু পর্যন্ত রেহাই পায়নি ।
মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বেওনেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হয় চার বছরের শিশুকে। শিশুটির মা হৃদয় বিদারক সেই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন আজও।১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর বানিয়াচং থেকে পাক-হানাদার মুক্ত হলে স্থানীয় রাজবাড়ীর আলী রাজা ও ইয়াহিয়া রাজা মহিলাদের বোরকা পড়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে গিয়েছিলো। মুক্তিবাহিনী ও বিক্ষুব্ধ জনতা রাজবাড়ীতে অগ্নি সংযোগ করে সব কিছু পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এদিকে, স্বাধীনতার পর মাকালকান্দি বধ্যভূমি ৩৬ বছর অযত্নে অবহেলায় পড়েছিল। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট গণহত্যা দিবসে ইউএনও আলম সিদ্দিকীর উদ্যোগে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ ও নির্মাণ করা হয়েছিল।