মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিকঃ বৃক্ষরোপণ অন্যতম একটি ইবাদত। ইসলামের দৃষ্টিতে একাজ অত্যন্ত পুণ্যময়। রাসুল (সাঃ) স্বয়ং বৃক্ষরোপণ করেছেন এবং বৃক্ষরোপণ করার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন। বৃক্ষরাজি সবুজ শ্যামল পাতা বিস্তার করে পরিবেশকে সুন্দর রাখে, আবহাওয়াকে স্বাস্থ্যকর করে তোলে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য অনুকূলে রাখে যা মহান মালিকের অপার করুণার পরিচায়ক।
ছোট্ট বীজটি হতে নির্দিষ্ট সময়ে চারা অংকুরোদগমিত হয়ে অত্যন্ত কোমল পাতা গজাতে থাকে এবং ধীরে ধীরে গাঢ় সুবজে তা ছেয়ে দেয় চারপাশকে।
রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন- কোন মুসলিম যদি একটি চারাগাছ রোপণ করে কিংবা বীজ বপন করে, তারপর সেই গাছ ও ফসল দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় কিংবা পশুপাখি খায়-তাহলে এর বিনিময়ে তার আমলনামায় সাদকাহ প্রদানের সাওয়াব লেখা হয় (মিশকাত)।
অনত্রে রাসুল (সাঃ) দু’টি কবরের উপরে দু’টি খেজুরের ডালের অংশ রোপণ করে বলেছিলেন, এ দু’টো কবরে আযাব হচ্ছে-দু’টি হালকা (মুক্ত থাকা সহজ) কারণে এ আযাব হচ্ছে, একজন মানুষের গোপন তথ্য একে অন্যের নিকট লাগিয়ে ঝগড়া বাধাত আর অপরজন পেশাব করে ভালভাবে পবিত্র হতো না। যতক্ষণ পর্যন্ত পাতাগুলো সতেজ থাকবে ততক্ষণ তাদের কবরের আযাবকে আল্লাহ তা’আলা হালকা করে দেবেন (বুখারি)।
উক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সতেজ পাতাও আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভের অন্যতম উপলক্ষ হয়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত আখেরাতের মঙ্গল কামনার জন্য সুবিধাজনক স্থানে বৃক্ষরোপণ করা। শূন্যস্থানসমূহকে সবুজ উদ্যানে পরিণত করা। যদ্বারা মৃত ব্যক্তিগণও উপকৃত হন।
বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু, মানুষ ও পরিবেশের আল্লাহর পক্ষ থেকে অমূল্য নেয়ামত। খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি, বাসস্থান, ওষুধপত্র, অর্থের যোগানদাতা হিসেবে বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষা ও উন্নয়নে বৃক্ষ গুরুত্বপূণর্ ভূমিকা পালন করে।
প্রাণিজগতের অস্তিত্ব উদ্ভিদ জগতের ওপর নিভর্রশীল এবং এ যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীকে বাসযোগ্য অবস্থানে গড়ে তোলা বা কোনো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অবশ্যই ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক।
কিন্তু আমাদের রয়েছে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন মাত্র ১০ ভাগ বনভূমি এবং ৭ ভাগ গ্রামেগঞ্জে রোপিত বা সৃজিত বনভূমি। যে দেশে বনভূমি যত বেশি সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের বনভূমি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এ থেকে বোঝা যায় বৃক্ষরোপণ আমাদের জন্য অতীব জরুরি।
বৃক্ষ পরম বন্ধু হয়ে গ্রিন হাউসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে, প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান দেয়, অক্সিজেন সরবরাহ করে, বাতাসের অতিরিক্ত কাবর্ন ডাইঅক্সাইড শোষণের মাধ্যমে পরিবেশ নিমর্ল রাখে, ক্ষতিকর দূষিত বাতাস শোধন করে জীবজগৎকে রক্ষা করে, সুশীতল ছায়া দেয়, মাটির ক্ষয় রোধ করে, মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে মাটির উবর্রতা রক্ষা করে, মাটিতে উপযুক্ত পরিমাণ পানি ধরে রাখে, জ্বালানি সরবরাহ করে, জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান ওষুধের কাঁচামালের যোগান দেয়, পশু-পাখি ও অন্যান্য বণ্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে, প্রাকৃতিক দুযোর্গ ঝড়-ঝঞ্ঝা জলোচ্ছ্বাস বন্যা রোধ করে।
বৃক্ষের দ্বারা বায়ু দূষণকারী পদাথর্ যেমন-কাবর্ন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড শোষণ করে এবং গাছের পাতা ঝড়-বাতাসের গতিকে রোধ করে, বৃষ্টির সৃষ্টি করে ও মরুময়তা রোধ করে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতিকে মায়াময় ও সৌন্দযর্ময় রূপে সাজিয়ে তোলে।
পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখা ও এর-অনুকূলে পরিশ্রম করার শিক্ষাও ইসলাম অত্যন্ত উত্তম রূপে প্রদান করেছে।
কেননা পযার্প্ত পরিমাণ বনভূমি ও বৃক্ষ না থাকার কারণে আমাদের প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তার মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, মরুময়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাতাসে কাবর্ন-ডাইঅক্সাইড বৃদ্ধি পাচ্ছে, জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ক্লোরোফ্লোরো কাবর্ন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ অনেক অনেক গুণ বেড়ে যাচ্ছে, বায়ুম-লের ওজন স্তরে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে- ফলে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসছে।
এসিড বৃষ্টি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেরু অঞ্চল ও এন্টারটিকা মহাদেশের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তেনর ফলে আগামী ২ দশকের মধ্যে সারা বিশ্বের ৬০০ মিলিয়ন মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে গবেষক ও বিশ্লেষকদের ধারণা।
জলবায়ু পরিবতর্নজনিত কারণে বতর্মানে বাষির্ক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১২৫ মিলিয়ন মাকির্ন ডলার যা ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে এবং জলবায়ু পরিবর্তেনর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।
এসব জটিল প্রাকৃতিক সমস্যাকে সফলভাবে মোকাবিলার জন্য এখনই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ইসলামের শিক্ষা মেনে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে পরিবেশকে সুন্দর ও মুক্ত রাখার জন্যও বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই।
বৃক্ষ নিধন অন্যতম একটি অপরাধ। কেননা এটিও একপ্রকার অপচয়। একাজ হতে আমাদেরকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও উত্তপ্ত জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামগ্রিক জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে।
পশু-পাখির প্রজনন ব্যাহত হওয়ার ফলে সুন্দর বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ আজ বিলুপ্ত প্রায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে হাজারো প্রজাতির পশু-পাখি ও জলজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে ৫ হাজার প্রজাতির গাছের মধ্যে ১০৬টির অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত। ৬৩২টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২টি প্রজাতি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত এবং ৩০টি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ১১০টি পশু প্রজাতির ৪০টির কোনো অস্তিত্ব নেই। ৭৮০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪টির অস্তিত্ব নেই বললে চলে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষি উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ২২ শতাংশ কৃষি জমি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই এ বিষয়টি আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে, বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত সবকিছুকেই আল্লাহ তা’আলা বিশেষ প্রয়োজনে সৃষ্টি করছেন। অপ্রয়োজনে এবং লোভের কারণে কখনই এগুলোকে নষ্ট করা উচিত নয়। এতে শরীয়াতের দৃষ্টিতে যেমনভাবে পাপী হতে হয়, তেমনিভাবে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতির জন্যও দায়ী হতে হয় যা মানবতার পরিপন্থী এবং যে কোন ধর্মের বিচারেও অন্যায়।
পক্ষান্তরে পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষরোপণ যেমন উপকারী, মানব সমাজেও তা সম্মানজনক ও সেবামূলক হিসেবে বিবেচিত আবার আল্লাহর অনন্ত সন্তুষ্টি লাভেরও অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
মহান মালিক আমাদের সকলকে এ গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি অনুধাবনের শক্তি দিন যাতে আমরাও তাঁর প্রিয় হতে পারি। তা হল – “বৃক্ষ নিধন নয় বরং পরিচর্যা করতে হবে, উত্তম পরিবেশ গড়তে, বৃক্ষরোপণ করতে হবে।”
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক, দৈনিক সিলেটের ডাক।