জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

আল্লামা তাফাজ্জুল হক হুজুর আর নেই

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী হুজুর ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

আজ রোববার বিকাল ৪ টা ৩৫ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি ইন্তেকাল করেন।

শায়খুল হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল হক “উমেদনগরের মুহাদ্দিস সাহেব” হিসাবে সমধিক পরিচিত।

১৯৪৪ সালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার কাটাখালি গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা মাওলানা আব্দুন নুর ছিলেন বড় মাপের আলেম।

৫ ভাইয়ের মধ্যে তিনিই বড়। লেখাপড়ার শুরুটা বাবার হাত ধরেই। তারপর রায়ধর মাদ্রাসা। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেন চট্ট্গ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায়।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত পীর ও আলেমে দ্বীন চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক শায়খুল হাদীস আল্লামা আহমদ শফি আল্লামা তাফাজ্জুল হকের শিক্ষক।

আহমদ শফিকে ঘিরেও চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেগ অনুভূতি জড়িত। তার উস্তাদদের মধ্যে আল্লামা শফি সাহেবই বর্তমানে জীবিত।

MAWLANA-TAFAZZUL-HAQUE

চট্টগ্রাম থেকে আল্লামা তাফাজ্জুল হক চলে যান পাকিস্তানে। পাকিস্তানের লাহোর জামেয়া আশরাফিয়া মাদ্রাসায় তিনি লেখাপড়া করেন।

সেখানকার তার উস্তাদ শায়খুল হাদিস আল্লামা রসুল খান ছিলেন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় আলেমে দ্বীন। লাহোর থেকে জ্ঞান আহরনের উদ্দেশ্যে আল্লামা তাফাজ্জুল হক চলে যান ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায়।

সেখানে তিনি উস্তাদ শায়খুল হাদিস ফখরুদ্দিন (র) এর সান্নিধ্য লাভ করেন। আল্লামা ফখরুদ্দিন (র) ছিলেন একাধারে পীর ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা।

ভারত পাকিস্তানের বিভিন্ন ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান আহরনের পর তিনি চলে আসেন বাংলাদেশে। শিক্ষকতার পেশা দিয়ে তার জ্ঞান বিতরণ কার্যক্রম শুরু।

শিক্ষা গ্রহণটা যেহেতু বাড়ি থেকে শুরু, শিক্ষা প্রদানটাও প্রায় একই স্থান থেকেই শুরু। রায়ধর মাদ্রাসার মুহাদ্দিস হিসাবে তিনি প্রথম শিক্ষকতার পেশা শুরু করেন।

একবছর তিনি সেখানে ছিলেন। পরে চলে যান কুমিল্লার বরুরায়। সেখানেও তিনি শিক্ষকতা করেন।

ময়মনসিংহের জামেয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসাসহ ময়মনসিংহ জেলায় তিনি বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। স্বাধীনতার পর পর তার উস্তাদরা তাকে পাঠিয়ে দেন নিজ জেলা হবিগঞ্জে।

প্রথমে তাকে মুহাদ্দিস হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় উমেদনগর মাদ্রাসায়। ১৯৫৭ সালে শায়খুল হাদিস মিছবাহুজ্জামানের প্রতিষ্ঠিত উমেদনগর মাদ্রাসায় তখনও দাওরায়ে হাদিস বিভাগ ছিল না।

আল্লামা তাফাজ্জুল হক এসে দাওরায়ে হাদিস বিভাগ চালু করেন। এরপর নিরন্তরভাবে হাদিস শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ৭১ থেকে ২০১৩ সাল।

এই দীর্ঘ সময়ে তিনি হাদিস শাস্ত্র পড়িয়ে অন্তত এক হাজার মুহাদ্দিস তৈরী করেন। যারা এখন দেশ বিদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

শুধুই কি পুরুষরা হাদিস শিক্ষা অর্জন করবে? মহিলারা বাদ যাবে কেন? শুধু এই চিন্তায় তিনি ১৯৯৭ সালে হবিগঞ্জের তেতৈয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন মাদানী নগর মহিলা মাদ্রাসা।

এই পর্যন্ত মহিলা মাদ্রাসা থেকে প্রায় ৩৬৫ জনেরও বেশি মহিলা মুহাদ্দিস সনদ নিয়ে বের হয়েছেন। তারা এখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি পরিবারে হাদিস শিক্ষা প্রদান করছেন।

শায়খুল হাদিস তাফাজ্জুল হক বিয়ে করেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ এর বড় হুজুর হিসাবে খ্যাত বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রবক্তা এবং বৃটিশদের কালো পতাকা প্রদর্শনকারী মাওলানা আরিফে রাব্বানীর কন্যাকে।

তার শ্যালক খালেদ সাইফুল্লাহ এখন ময়মনসিংহের জনপ্রিয় আলেম। তাফাজ্জুল হকের ৫ ছেলের মধ্যে ৫জনই প্রখ্যাত মাওলানা। তাদের মাঝে ৪জন কোরআানে হাফেজ।

শায়খুল হাদীস আল্লামা তাফাজ্জুল হক

৪ কন্যার মধ্যে সবাই টাইটেল পাশ আলেমা। নাতী নাতনীদের প্রায় সবাই কোরআনে হাফেজ ও মাওলানা। বড় ছেলে-হাফেজ মাসরুরুল হক উমেদনগর মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক।

২য় ছেলে-হাফেজ তাসনিমুল হক মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের পরিচালক, ৩য় ছেলে- হাফেজ তাফহিমুল হক একজন মুহাদ্দিস, ৪র্থ ছেলে মাওলানা মামনুনুল হক মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক, ৫ম ছেলে মাবরুরুল হক একজন মাওলানা।

৪ কন্যার সবাই মাদ্রাসার শিক্ষিকা। ৫ ভাইয়ের মধ্যে তাফাজ্জুল হক সবার বড়। ২য় ভাই লন্ডন প্রবাসী ইমদাদুল হক একজন শায়খুল হাদিস। ৩য় ভাই হাফেজ শামসুল হক সাদী একজন প্রখ্যাত মাওলানা।

শামসুল হক সাদীর ২ ছেলে কোরআনে হাফেজ। ৪র্থ ভাই ডাক্তার সিরাজুল হক, আমেরিকা প্রবাসী, ৫ম ভাই হাফেজ মাওলানা আহমদুল হক ওআইসি ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর।

mawlana tafazzul haque

বিভিন্ন প্রয়োজনে আল্লামা তাফাজ্জুল হক লন্ডন আমেরিকা কানাডাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সফর করেন। তিনি জীবনে ৩৮ বার পবিত্র হজ্জব্রত পালন করেন।

তার উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নুর হোসাইন কাসেমী, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, মাওলানা নেজাম উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন আলেম এখন দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

নুরুল হেরা জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ একাধিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। গরীব দুঃখীদের সাহায্যার্থে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন খুদ্দামুদ্দিন সমিতি।

এই সমিতি থেকে বিভিন্ন প্রকাশনাও বের করা হয়। তার ওয়াজ শুনার জন্য হাজার হাজার মানুষ এখনও নির্ঘুম রাত কাটান। জুমার খুৎবা শুনতে নুরুল হেরা মসজিদে প্রতি জুমাবারই প্রচুর মুসল্লীর সমাগম ঘটে।

দেশে বিদেশে লক্ষাধিক ভক্তের এক বিশাল পরিবার নিয়ে তার সংসার।

সপেদ লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী, টুপি-ই তার প্রিয় পোষাক। সাধারণ মানুষের মতো চলতে ভালবাসতেন আল্লামা তাফাজ্জুল হক। রাগ একটুকু বেশি ছিল তবে বদমেজাজী ছিলেন না। রাগান্বিত চেহারায়ও তার ঠোটে লেগে থাকত হাসির ঝিলিক।