আগামী ৬ই মে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৬ষ্ট স্কটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচন। ২০০০ সালে চালু হওয়া এই পার্লামেন্টে মুলত: স্কটীশ জণগনের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ট্রান্সপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাছাড়া কয়েক প্রকার পাবলিক বেনিফিট এবং ট্যাক্স সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করার ক্ষমতা রয়েছে স্কটিশ পার্লামেন্টের।
প্রতি চার বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১২৯ জন এমএসপি (মেম্বার অব স্কটিশ পার্লামেন্ট) নির্বাচিত হন। বিভিন্ন কারণে এ বছরের নির্বাচনটি অনেকের কাছে তাৎপর্যপুর্ন।
বিশেষ করে বাংলাদেশী কমিউনিটির কাছে এবারের নির্বাচনটি বিশেষ ভাবে স্মরণীয় কেননা এবারই প্রথম কোন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত প্রার্থী স্কটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন।
স্কটিশ লেবার পার্টি থেকে লোদিয়ান রিজিওন্যাল লিষ্ট প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন পেয়েছেন এডিনবরার ফয়ছল চৌধুরী এমবিই। ইকুয়ালিটি এন্ড হিউম্যান রাইট এক্টিভিস্ট ফয়ছল চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে লেবার পার্টির রাজনীতির সাথে যুক্ত রয়েছেন। ইতিপুর্বে লেবার পার্টি থেকে ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত ওয়েষ্ট মিনিষ্টার পার্লামেন্ট নির্বাচনে এডিনবরা সাউথওয়েষ্ট আসনে লড়াই করেন ফয়ছল চৌধুরী। এছাড়া ২০১৪ সালে স্কটিশ রেফারেন্ডাম চলাকালীন ‘বাংলাদেশীজ ফর বেটার টোগেদার ক্যাম্পেইন‘ এর সমন্বয়কারী ছিলেন তিনি। ঐতিহাসিক গনভোট এবং অন্যান্য মূলধারায় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে স্থানীয় বাংলাদেশী কমিউনিটিকে যুক্ত করতে রয়েছে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভুমিকা।
ফয়ছল হোসেন চৌধুরীর জন্ম হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার বদরদি গ্রামে। বাবার নাম আলহাজ্ব গোলাম রব্বানী চৌধুরী। মা–বাবার সাথে তরুন বয়সে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। প্রথমে ম্যানঞ্চেষ্টার এবং পরে এডিনবরায় বসবাস শুরু করেন। বাবা শারিরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে বড় ছেলে হিসাবে সেই তরুন বয়সেই পরিবারের হাল ধরেন ফয়ছল চৌধুরী। তখন থেকেই যুক্ত রয়েছেন পারিবারিক কেটারিং ব্যাবসায়।
ব্যাবসার পাশাপাশি পরিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী তরুণ বয়সেই শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম। মামা ড. ওয়ালী তসর উদ্দিন এমবিই –র আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর কাছেই কমিউনিটি ওয়ার্কের হাতেখড়ি হয় ফয়ছল চৌধুরীর।
দীর্ঘদিন যাবত এডিনবরা এন্ড লোদিয়ান রিজিওন্যাল ইকুয়ালিটি কাউন্সিল (এলরেক) এর চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বিভিন্ সংখ্যালঘু কমিউনিটির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখার জন্য ২০০৪ সালে ব্রিটেনের রাণী কতৃক ‘এমবিই‘ খেতাবে ভুষিত হন তিনি।
সম্প্রতি করোনা মহামারী চলাকালে, ২০২০ সালের জুন মাসে এডিনবরায় বসবাসরত অভাবগ্রস্থ এথনিক মাইনরিটি পরিবারগুলির মধ্যে খাদ্যদ্রব্য বিতরনের লক্ষ্যে তিনি চালু করেন ফুড সাপোর্ট প্রজেক্ট। ফয়ছল চৌধুরীর নেতৃত্বে এলরেক এর উদ্যোগে এই প্রকল্পের আওতায় প্রতি সপ্তাহে ৩০টির ও বেশী অসহায় পরিবারকে জরুরী খাবার পৌছে দেয়া হয়। প্রকল্পটি বর্তমানে চালু রয়েছে।
ফয়ছল চৌধুরী বর্তমানে স্কটিশ মুলধারায় নানাবিধ কর্মকান্ডে সক্রিয় ভাবে যুক্ত রয়েছেন যেমন– ক্লাইমেট ইমার্জেন্সী স্কটল্যান্ড এর চেয়ার, এডিনবরা স্লেভারী এন্ড কলোনিয়াল লেগাসী রিভিউ গ্রুপ এর কার্যকরী পর্ষদের সদস্য, মিউজিয়াম এন্ড গ্যালারীস স্কটল্যান্ড – এর বোর্ড মেম্বার, ইএসএমএস এর ইকুয়ালিটি এন্ড ডাইভার্সিটি টাস্ক ফোর্সের এডাভাইসার এবং ড্রামন্ড হাই স্কুল প্যারেন্ট কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
স্কটল্যান্ডের বৃহত্তম মাল্টিকালচারাল আয়োজন ’এডিনবরা মেলা’–র প্রতিষ্টাকালীন ও বর্তমান ডাইরেক্টর ফয়ছল চৌধুরী – গিল্ড অব বাংলাদেশী রেষ্টুরেণ্টার ইন স্কটল্যান্ড–র প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সমিতি এডিনবরার চেয়ারম্যান, কাউন্সিল অব বাংলাদেশীজ ইন স্কটল্যান্ড (সিবিএস) এর সাধারন সম্পাদক এবং যুক্তরাজ্য নবিগঞ্জ এডুকেশন ট্রাস্ট–র ট্রাস্টি মেম্বার হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সাইক্লোন আপিল এবং ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সাইক্লোন সিডর আপিলে তিনি অসামান্য ভুমিকা রাখেন।
স্কটিশ পার্লামেন্টের নির্বাচন পদ্ধতি:
স্কটিশ পার্লামেন্টের ভোটিং পদ্ধতিতে কে বলা হয় এডিশনাল মেম্বার সিস্টেম বা এএমএস। এই পদ্ধতিতে একজন ভোটার দুইটি পৃথক ব্যালটে ভোট দেন।
প্রথম ব্যালটে (হালকা বেগুনী/ছোট সাইজের) ভোটের মাধ্যমে স্থানীয় আসনের জন্য একজন এমএসপি নির্বাচিত করা হয়। স্কটল্যান্ডে এধরণের মোট ৭৩ টি আসন রয়েছে। লোদিয়ান আঞ্চলে এরকম ৯ টি নির্বাচনী আসন রয়েছে। সর্বাধিক ভোট পেয়ে প্রত্যেক আসনে আলাদা আলাদা ভাবে ১ জন করে এমএসপি নির্বাচিত হবেন।
দ্বিতীয় ব্যালটে (হালকা কমলা রং/লম্বা সাইজের) যে ভোটটি দেয়া হবে সেটি হচ্ছে একটি পছন্দের রাজনৈতিক দলকে। পুরো স্কটল্যান্ডে এরকম ৮টি রিজিওন রয়েছে। প্রতি রিজিওনে ৭ জন করে রিজিওন্যাল এমএসপি নির্বাচিত হন এই ২য় ব্যালটে দেয়া ভোটের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় ব্যালটে প্রাপ্ত ভোট থেকে অনুপাতিক হারে ক্রমানুসারে বিভিন্ন পার্টি থেকে প্রতি অঞ্চলে ৭ জন করে মোট ৫৬ জন এমএসপি নির্বাচিত হন। এই ধরণের ভোটকে সাধারণত ‘লিস্ট‘ ভোট ও বলা হয়।
একটি জটিল গাণিতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লিস্ট ব্যালটে প্রাপ্ত ভোট থেকে প্রত্যোক রাজনৈতিক দল কতজন এমএসপি নির্বাচিত হবেন তা নির্ধারন করা হয়ে থাকে।
প্রত্যেক পার্টি আগে থেকেই তাদের রিজিওনে লিস্টের প্রার্থীদের নাম ক্রমানুসারে নির্ধারণ করে রাখে। সাধারণত কোন পার্টির লিস্ট প্রার্থীদের তালিকায় থেকে ১ থেকে ৪ এর মধ্যে যাদের অবস্থান তারাই এমএসপি হিসাবে নির্বাচিত হতে পারেন।
ফয়ছল চৌধুরী লোদিয়ান লিস্টে লেবার পার্টির ৩য় স্থানে রয়েছেন। এ অঞ্চলে লেবার পার্টির প্রথম স্থানে যার নাম তিনি অন্য একটি সংসদীয় আসনের প্রার্থী ও বটে। এখন যদি ১ম স্থানে থাকা ঐ প্রার্থী তার নিজ আসনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে যান তাহলে ‘লিস্টে‘ ফয়ছল চৌধুরীর অবস্থান ২য় স্থানে উঠে আসবে। বিগত বছরগুলিতে লোদিয়ান অঞ্চলে লেবার পার্টির লিস্ট থেকে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থানে থাকা প্রার্থীরা এমএসপি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। এখন পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে লিস্ট ব্যালটে লেবার পার্টির প্রাপ্ত মোট ভোটের উপর।
লকডাউন নীতিমালা অনুসরন করে লোদিয়ানব্যাপী ব্যাপকভাবে নির্বাচন প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন ফয়ছল চৌধুরী।
তিনি হবিগঞ্জ নিউজকে বলেন, “স্কটীশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে বাঙালী কমিউনিটির অংশগ্রহন খুবই তাৎপর্যপুর্ন। ভোটারদের কাাছ থেকে অভুতপুর্ব সাড়া মিলছে। এতে আমি অত্যন্ত অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আমাদের লালিত স্বপ্ন পুরণের ব্যাপারে আমি প্রচন্তরকম ভাবে আত্মবিশ্বাসী ও আশাবাদী। এতে কমিউনিটির দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করছি”
ফয়ছল চৌধুরী আরও বলেন, “স্কটল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশীদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি যে, আপনারা বেশী বেশী করে মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হোন এবং এর মাধ্যামে আপনাদের দাবী দাওয়া সরকারের নিকট তুলে ধরুন । প্যানডেমিক পরবর্তী স্কটীশ অর্থনীতি বিনির্মানে লেবার পার্টি যে কর্মসুচী হাতে নিয়েছে তা বাস্তবায়নে আপনারা আপনাদের দুইটি ভোটই লেবার পার্টিকে দিন”