ইতিমধ্যে হবিগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন শায়খুল হাদীস আল্লামা তাফাজ্জুল হক ইসলাম প্রিয় মানুষের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছেন। তাকে ঘিরে সাধারণ মুসল্লীদের আবেগ অনুভূতি বাধ ভাঙ্গা জুয়ারের মতো।
হাত তুলে মোনাজাতের সময় তিনি কাঁদলে শতশত মানুষ একসাথে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি স্বাভাবিক, সাধারণ। ইসলামের বিরুদ্ধে যে কোনো সংগ্রামে তিনি অগ্রনায়ক।
প্রায় ৭০ বছর বয়স্ক শায়খুল হাদিস তাফাজ্জুল হক এখনও বাতিল মতাদর্শীদের কাছে আতংক।
তাসলিমা হঠাও আন্দোলনে যেমন তিনি নির্দেশকদের একজন, তেমনি হুমায়ুন আজাদের ঘৃণিত পুস্তক “পাকসার জমিন সাদবাদ” এর ও তিনি কড়া সমালোচক।
সবসময় সমঝোতায় বিশ্বাসী এই মানুষটি ইসলাম বিদ্ধেষীদের সাথে কখনও সমঝোতা করতে নারাজ। তাদের সাথে লড়াই করতেই ভালবাসেন তিনি।
গতকাল তার সর্বশেষ কথা- “আমাকে মেরে ফেললে যদি ইসলাম বিদ্বেষীদের পক্ষাবলম্বনকারী আওয়ামীলীগের কলিজা ঠান্ডা হয়, তাহলে আমি একশবার মরতে রাজী”।
সমস্বরে হাজারো কন্ঠে আওয়াজ উঠে “ আপনি একশবার মরতে রাজী হলে আমার হাজার বার মরতে রাজী”। এ সময় আওয়ামীলীগের দলীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মজিদ খানও পাশে ছিলেন। সত্য কথা বলতে তিনি তোয়াক্কা করেন না।
কোরআন হাদিসের আলোকে বক্তব্য রাখতে তিনি কারো রক্তচক্ষুকে ভয় করেন না। কেন একজন শায়খুল হাদীস আল্লামা তাফাজ্জুল হক সাহেবের কথায় মুহুর্তে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়?
কেন তাকে ঘিরে ইসলাম বিদ্ধেষীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মুসল্লী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে? আবার শত্র লোকদের কাছে পেয়েও একমাত্র তার কথায় কেন সবাই চুপ হয়ে যায়?
এসব কারণ জানতে বিভিন্ন মাধ্যমে শ্রদ্ধেয় এই আলেম সম্পর্কে বিভিন্ন জনের সাথে কথা হয়। বেরিয়ে আসে তার সম্পর্কে নানাবিধ তথ্য। সেই তথ্য অনেকে জানেন আবার অনেকে না জেনেই অন্ধ ভক্তের মতো তাকে ভালবাসেন।
শায়খুল হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল হক “ উমেদনগরের মুহাদ্দিস সাহেব” হিসাবে সমধিক পরিচিত।
১৯৪৪ সালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার কাটাখালি গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা মাওলানা আব্দুন নুর ছিলেন বড় মাপের আলেম।
৫ ভাইয়ের মধ্যে তিনিই বড়। লেখাপড়ার শুরুটা বাবার হাত ধরেই। তারপর রায়ধর মাদ্রাসা। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেন চট্ট্গ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায়।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত পীর ও আলেমে দ্বীন চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক শায়খুল হাদীস আল্লামা আহমদ শফি আল্লামা তাফাজ্জুল হকের শিক্ষক।
আহমদ শফিকে ঘিরেও চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেগ অনুভূতি জড়িত। তার উস্তাদদের মধ্যে আল্লামা শফি সাহেবই বর্তমানে জীবিত।
চট্টগ্রাম থেকে আল্লামা তাফাজ্জুল হক চলে যান পাকিস্তানে। পাকিস্তানের লাহোর জামেয়া আশরাফিয়া মাদ্রাসায় তিনি লেখাপড়া করেন।
সেখানকার তার উস্তাদ শায়খুল হাদিস আল্লামা রসুল খান ছিলেন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় আলেমে দ্বীন। লাহোর থেকে জ্ঞান আহরনের উদ্দেশ্যে আল্লামা তাফাজ্জুল হক চলে যান ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায়।
সেখানে তিনি উস্তাদ শায়খুল হাদিস ফখরুদ্দিন (র) এর সান্নিধ্য লাভ করেন। আল্লামা ফখরুদ্দিন (র) ছিলেন একাধারে পীর ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা।
ভারত পাকিস্তানের বিভিন্ন ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান আহরনের পর তিনি চলে আসেন বাংলাদেশে। শিক্ষকতার পেশা দিয়ে তার জ্ঞান বিতরণ কার্যক্রম শুরু।
শিক্ষা গ্রহণটা যেহেতু বাড়ি থেকে শুরু, শিক্ষা প্রদানটাও প্রায় একই স্থান থেকেই শুরু। রায়ধর মাদ্রাসার মুহাদ্দিস হিসাবে তিনি প্রথম শিক্ষকতার পেশা শুরু করেন।
একবছর তিনি সেখানে ছিলেন। পরে চলে যান কুমিল্লার বরুরায়। সেখানেও তিনি শিক্ষকতা করেন।
ময়মনসিংহের জামেয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসাসহ ময়মনসিংহ জেলায় তিনি বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। স্বাধীনতার পর পর তার উস্তাদরা তাকে পাঠিয়ে দেন নিজ জেলা হবিগঞ্জে।
প্রথমে তাকে মুহাদ্দিস হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় উমেদনগর মাদ্রাসায়। ১৯৫৭ সালে শায়খুল হাদিস মিছবাহুজ্জামানের প্রতিষ্ঠিত উমেদনগর মাদ্রাসায় তখনও দাওরায়ে হাদিস বিভাগ ছিল না।
আল্লামা তাফাজ্জুল হক এসে দাওরায়ে হাদিস বিভাগ চালু করেন। এরপর নিরন্তরভাবে হাদিস শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ৭১ থেকে ২০১৩ সাল।
এই দীর্ঘ সময়ে তিনি হাদিস শাস্ত্র পড়িয়ে অন্তত এক হাজার মুহাদ্দিস তৈরী করেন। যারা এখন দেশ বিদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
শুধুই কি পুরুষরা হাদিস শিক্ষা অর্জন করবে? মহিলারা বাদ যাবে কেন? শুধু এই চিন্তায় তিনি ১৯৯৭ সালে হবিগঞ্জের তেতৈয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন মাদানী নগর মহিলা মাদ্রাসা।
এই পর্যন্ত মহিলা মাদ্রাসা থেকে ২২৫ জনেরও বেশি মহিলা মুহাদ্দিস সনদ নিয়ে বের হয়েছেন। তারা এখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি পরিবারে হাদিস শিক্ষা প্রদান করছেন।
শায়খুল হাদিস তাফাজ্জুল হক বিয়ে করেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ এর বড় হুজুর হিসাবে খ্যাত বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রবক্তা এবং বৃটিশদের কালো পতাকা প্রদর্শনকারী মাওলানা আরিফে রাব্বানীর কন্যাকে।
তার শ্যালক খালেদ সাইফুল্লাহ এখন ময়মনসিংহের জনপ্রিয় আলেম। তাফাজ্জুল হকের ৫ ছেলের মধ্যে ৫জনই প্রখ্যাত মাওলানা। তাদের মাঝে ৪জন কোরআানে হাফেজ।
৪ কন্যার মধ্যে সবাই টাইটেল পাশ আলেমা। নাতী নাতনীদের প্রায় সবাই কোরআনে হাফেজ ও মাওলানা। বড় ছেলে-হাফেজ মাসরুরুল হক উমেদনগর মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক।
২য় ছেলে-হাফেজ তাসনিমুল হক মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের পরিচালক, ৩য় ছেলে- হাফেজ তাফহিমুল হক একজন মুহাদ্দিস, ৪র্থ ছেলে মাওলানা মামনুনুল হক মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক, ৫ম ছেলে মাবরুরুল হক একজন মাওলানা।
৪ কন্যার সবাই মাদ্রাসার শিক্ষিকা। ৫ ভাইয়ের মধ্যে তাফাজ্জুল হক সবার বড়। ২য় ভাই লন্ডন প্রবাসী ইমদাদুল হক একজন শায়খুল হাদিস। ৩য় ভাই হাফেজ শামসুল হক সাদী একজন প্রখ্যাত মাওলানা।
শামসুল হক সাদী;র ২ ছেলে কোরআনে হাফেজ। ৪র্থ ভাই ডাক্তার সিরাজুল হক, আমেরিকা প্রবাসী, ৫ম ভাই হাফেজ মাওলানা আহমদুল হক ওআইসি ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর।
বিভিন্ন প্রয়োজনে আল্লামা তাফাজ্জুল হক লন্ডন আমেরিকা কানাডাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সফর করেন। তিনি জীবনে ৩৮ বার পবিত্র হজ্জব্রত পালন করেন।
তার উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নুর হোসাইন কাসেমী, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, মাওলানা নেজাম উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন আলেম এখন দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
নুরুল হেরা জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ একাধিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। গরীব দুঃখীদের সাহায্যার্থে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন খুদ্দামুদ্দিন সমিতি।
এই সমিতি থেকে বিভিন্ন প্রকাশনাও বের করা হয়। তার ওয়াজ শুনার জন্য হাজার হাজার মানুষ এখনও নির্ঘুম রাত কাটান। জুমার খুৎবা শুনতে নুরুল হেরা মসজিদে প্রতি জুমাবারই প্রচুর মুসল্লীর সমাগম ঘটে।
দেশে বিদেশে লক্ষাধিক ভক্তের এক বিশাল পরিবার নিয়ে তার সংসার।
তার কাছে মুরিদ হতে দেশ বিদেশের মানুষ এখনও তার বাসায় চলে আসেন। তবে তথাকথিত পীর ইজম নির্লোভ এই মানুষটির বরাবরই অপছন্দ। সপেদ লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী, টুপি-ই তার প্রিয় পোষাক।
সাধারণ মানুষের মতো চলতে ভালবাসেন আল্লামা তাফাজ্জুল হক। অতি রাগী তবে কখনও বদমেজাজী নন। রাগান্বিত চেহারায়ও তার ঠোটে লেগে থাকে হাসির ঝিলিক।
শায়খুল হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল এখন ইসলাম প্রিয় মানুষের কাছে ঢাকার পূর্বাংশের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ট মুরুব্বী।
শারিরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ্য এই মানুষটি ইসলাম বিদ্ধেষীদের বিরুদ্ধে আয়োজিত মিছিল সমাবেশে এখনও হুইল চেয়ারে করে অংশ গ্রহণ করেন।
বিঃদ্রঃ ২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী তারিখে আমার এ লেখাটি কোনো ধরনের কাটছাট ছাড়াই পোষ্ট করা হল। ইতিমধ্যে অনেক তথ্য সংযোজন করার মতো। কিন্তু করা হয়নি। তিনি বর্তমানে অসুস্থ।
সিলেটের মাউন্ট এডোরা হাসপাতাল থেকে হেলিকপ্টারে করে রবিবার (২৯ সেপ্টম্বর) ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
অসুস্থ্য এ আলেমে দ্বীনের জন্য সকলের কাছে দোয়া প্রার্থী। তার জুমার খুৎবা পরের দিনের পত্রিকাগুলোতে ছাপানোর জন্য আমি প্রেরণ করতাম।
হবিগঞ্জের প্রায় সকল পত্রিকা, কোনো কোনো সময় জাতীয় পত্রিকায় উনার জুমার খুৎবা প্রচার হতো। আমি অনেকবার উনার বায়োগ্রাফী লেখার জন্য অনুমতি চেয়েছি কিন্তু তিনি তাতে রাজী হননি।
সহাস্যে বলতেন আমি তো এমন কেউ নই যে আমার জীবনী লেখার প্রয়োজন হবে। তারপরও আমি চেষ্টা করে আসছি উনার সম্পর্কে কিছু লেখার।
যদি কারও কাছে সঠিক কোনো তথ্য থাকে তাহলে আমার ইনবক্সে, ইমেইলে, মোবাইল ফোনে বা চিঠির মাধ্যমে জানালে খুশি হব।
লেখকঃ এম এ মজিদ, হবিগঞ্জ।
আইনজীবি ও সংবাদকর্মী